চার বছর ধরে লাভপুর-কাণ্ডের চার্জশিট না দেওয়া নিয়ে হাইকোর্টে মামলা উঠবে যে কোনও দিন। এই চাপের মুখে পুলিশ বোলপুর আদালতে চার্জশিট জমা দিলেও তাতে সিপিএম সমর্থক তিন ভাইকে হত্যার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত, লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের নাম নেই। পুলিশ সূত্রের খবর, শুধু মনিরুলই নন, চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে আরও ২১ জন অভিযুক্তের নাম।
পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ হত্যা মামলার অনতম অভিযুক্ত, বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এখনও পুলিশ বা বিশেষ তদন্তকারী দলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বিধায়ক মনিরুল সেই অনুব্রতরই ঘনিষ্ঠ। দু’জনকেই এ বারের লোকসভা ভোটের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে দেখা গিয়েছে। এই অবস্থায় লাভপুর-পাড়ুই, দু’টি মামলারই অভিযোগকারীদের প্রশ্ন, অভিযুক্তদের মাথায় শাসক দলের নেতৃত্বের হাত থাকাতেই কি এমনটা ঘটছে?
বীরভূমে লাভপুরের নবগ্রামে ২০১০-এর ৪ জুন খুন হন সিপিএম সমর্থক তিন ভাই। অভিযোগ ওঠে মনিরুলের বাড়িতে সালিশি সভার জন্য ডেকে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে ও বোমা মেরে খুন করা হয়েছিল তাঁদের। মনিরুল তখন তৃণমূলের জেলা শাখার সহ-সভাপতি। ওই ঘটনায় মনিরুল-সহ মোট ৫১ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের হয়। মাস দুই গা ঢাকা দিয়ে থাকার পরে ওই বছর অগস্টে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। জামিনে ছাড়া পেয়ে নির্বাচনে দাঁড়ান। জিতে শাসক দলের বিধায়ক হন প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মনিরুল। পুলিশ তখন ওই ঘটনার চার্জশিট পেশ করেনি।
দীর্ঘ চার বছরেও চার্জশিট জমা না পড়ায় হাইকোর্টে মামলা করেছেন নিহতদের ভাই সানোয়ার শেখ।এত দিনে কেন চার্জশিট জমা দেওয়া গেল না, এই প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত ইতিমধ্যেই এক দফা ভর্ৎসনা করেছেন জেলা পুলিশকে। সানোয়ারের আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বুধবার বলেন, “যে কোনও দিন মামলাটি শুনানির জন্য হাইকোর্টে উঠবে। মনিরুলের নাম চার্জশিটে না থাকার বিষয়টি আমি আদালতের নজরে আনব।” সুব্রতবাবু আরও জানান, সম্প্রতি মনিরুল নিজে ওই খুনের কথা স্বীকার করেছেন প্রকাশ্য সভায়। তা-ও কেন পুলিশ তাঁকে ছাড় দিল, হাইকোর্টে শুনানির সময় তা জানতে চাইবেন তিনি।
বিচারপতি দত্তর এজলাসে সেই মামলাটি ওঠার মুখে মঙ্গলবার বোলপুর আদালতে যে চার্জশিট জেলা পুলিশ জমা দিয়েছে, তাতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুন ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে।
কী কারণে পুলিশ চার্জশিট থেকে বাদ দিল মনিরুলের নাম? বোলপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ফিরোজ কুমার পাল বলেন, “সরাসরি বিচারকের কাছে চার্জশিট জমা পড়েছে। আমি চার্জশিট দেখিনি। তাতে কী লেখা আছে, তা আমি জানি না।” জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়ও বলেন, “চার্জশিট হাতে পাইনি। তাতে কী আছে, না দেখে কোনও মন্তব্য করব না।” আর বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
তবে মনিরুলের দাবি, “সাক্ষী এবং অভিযোগকারী পরিবারের লোকেরাই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন যে, আমি ওই ঘটনায় জড়িত ছিলাম না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই খুনের মামলায় আমার নাম থাকার কথাও নয়। পুলিশ তদন্তের ভিত্তিতেই আমার নাম বাদ দিয়েছে।” মনিরুলের পাল্টা অভিযোগ, তাঁকে ওই খুনের ঘটনায় জড়ানো হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলও পুলিশের ভূমিকাকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মন্তব্য, “শাসক দলের প্রভাব খাটানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশ যা উপযুক্ত মনে করেছে, তা-ই করেছে।”
পুলিশের এই ভূমিকায় মোটেই অবাক নন নিহত তিন ভাইয়ের মা জরিনা বিবি। ঘরছাড়া জরিনা এখন রয়েছেন মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে। সেখান থেকে তিনি বলেন, “আমাদের আশঙ্কাটাই সত্যি হল। শাসক দলের বিধায়ক বলেই পুলিশ একটা খুনিকে ছাড় দিল।” জরিনার পরিবারের অভিযোগ, অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ হওয়াতেই পুলিশ মনিরুলের নাম রাখেনি চার্জশিটে।
এঁরাই তবে আদালতে মনিরুল জড়িত নন বলে জবানবন্দি দিয়েছিলেন কেন?
সানোয়ার এই প্রসঙ্গে বলেন, “পরিবারের তিন জন তখন খুন হয়ে গিয়েছেন। আমরা সন্ত্রস্ত ছিলাম। কাউকে পাশে পাইনি। ওই সময় মনিরুলের হুমকিতেই জবানবন্দিতে তাঁর নাম নিতে পারিনি।” সম্প্রতি তা উল্লেখ করে আগের সেই জবানবন্দি প্রত্যাহার করে নতুন জবানবন্দি দেওয়ার জন্য হাইকোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছেন সানোয়ার। তাঁর আর এক ভাই আনারুল শেখ ও মা জরিনা দাবি করেন, মামলা শুরুর পরেই মনিরুল ও তাঁর অনুগামীরা তাঁদের ভাইপো-ভাগ্নিকে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহরণ করেছিল। আনারুলের কথায়, “মনিরুল জড়িত নন, এই মর্মে আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য লাভপুর থানার এক পুলিশ-কর্তা সে সময় আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, অপহরণের অভিযোগ জানানোরও সুযোগ পাইনি। প্রাণ বাঁচাতেই তখন মনিরুল নির্দোষ বলে জবানবন্দি দিতে বাধ্য হয়েছিল আমাদের পরিবার।”
শাসক দলের প্রভাব নিয়ে এমন অভিযোগ উঠেছে পাড়ুইয়েও। নিহত সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষ এ দিন বলেন, “অনুব্রতর পাশে মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন বলেই পুলিশ তাঁকে ধরেনি। মনিরুলের মাথাতেও নিশ্চয় মুখ্যমন্ত্রীর হাত রয়েছে।” পাড়ুই-কাণ্ডেও পুলিশ চার্জশিট থেকে আসল অভিযুক্তদের নাম বাদ দিতে পারে বলে আশঙ্কায় রয়েছেন হৃদয়বাবু। তাঁর বাবার হত্যার মামলায় বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তই মন্তব্য করেছিলেন, ‘অনুব্রত মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য হওয়ায় সিটের প্রধান ডিজি এবং অন্য অফিসাররা ওঁকে ছোঁয়ার সাহস করছেন না।’
লাভপুর-কাণ্ডের চার্জশিটে মনিরুলের নাম না থাকা নিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “শাসক দলের জন্য এ রাজ্যে আইন-কানুন নেই, সংবিধান নেই। তাই এ সব করেও তারা পার পেয়ে যায়।
আর কিছু না-করেও হাজার-হাজার লোককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসতে হয়।” মিথ্যা অভিযোগের নজির হিসেবে রায়দিঘি-কাণ্ডে প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম জড়ানো এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার শিক্ষক-নেতা বিমল ভাণ্ডারীর গ্রেফতারের কথা উল্লেখ করেন সূর্যবাবু।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, মনিরুল বরাবরই এলাকায় দাপুটে নেতা হিসেবে পরিচিত। ফরওয়ার্ড ব্লকে থাকার সময় বারবার সংঘাতে জড়িয়েছেন সিপিএমের সঙ্গে। ২০০৯-এ লোকসভা ভোটের পরে অনুব্রত মণ্ডলের উপস্থিতিতে তিনি সদলবল তৃণমূলে েযাগ দেন। তাতে েকাণঠাসা হয়ে পড়েন তৃণমূলের বহু পুরনো নেতা-কর্মী। লাভপুরে দলেরই বুথকর্মী খুনে অভিযুক্ত দুষ্কৃতী েগাপাল শেখকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তবু অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁর দাপট দিনে-দিনে বেড়েছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে লাভপুর ব্লকে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েতসমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতের েকানও আসনে তৃণমূল ছাড়া অন্য দল প্রার্থীই দিতে পারেনি। যার পিছনে মনিরুলেরই বিশেষ ‘কৃতিত্ব’ রয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। এমন এক দাপুটে নেতার নাম মামলা থেকে বাদ পড়ার খবর শুনে তিন ছেলে হারানো জরিনা বিবি বললেন, “এখানকার আদালতে বিচার হল না, তাতে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আল্লার উপর আমার ভরসা আছে। শেষবিচার রয়েছে, আল্লার হাতে। তিনিই আমার তিন ছেলের খুনিদের সাজা দেবেন।”
সহপ্রতিবেদন: মহেন্দ্র জেনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy