উপনির্বাচনের জন্য মঙ্গলবার শহরে এল আধাসেনা।—নিজস্ব চিত্র।
একে লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্যের পরে আবার জনমতের পরীক্ষা। তায় সারদা-কাণ্ডে সিবিআই ধরপাকড় শুরু করার পরে নির্বাচন। মুখরক্ষার তাগিদে তাই চৌরঙ্গি এবং বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন জিততে মরিয়া তৃণমূল। রাজ্যের নানা জায়গা থেকে লোকলস্কর নিয়ে এবং প্রায় গোটা মন্ত্রিসভাকে ময়দানে নামিয়ে বিরোধীদের টেক্কা দিতে চাইছে তারা। আর শাসক দলের এই তৎপরতা দেখেই উপনির্বাচন ঘিরে অশান্তির আশঙ্কা করছে বিরোধী শিবির। ভোটের দিন যত কাছাকাছি আসছে, নির্বাচন কমিশনের উপরে তত চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতারা।
চার মাস আগের লোকসভা ভোটের নিরিখে দেখলে চৌরঙ্গি ও বসিরহাট দক্ষিণ, দুই বিধানসভা কেন্দ্রেই পিছিয়ে রাজ্যের শাসক দল। চৌরঙ্গিতে অল্প ভোটে হলেও তারা পিছিয়ে কংগ্রেসের কাছে। আর বসিরহাটে ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে তাদের পিছনে রেখেছে বিজেপি। লোকসভা ভোটে সদ্য যে দল ৩৪টি আসন জিতেছে, কয়েক মাসের মধ্যে উপনির্বাচনে অন্য রকম কিছু আটকাতে তাদের তৎপরতা থাকবেই। এরই মধ্যে এসে পড়েছে সারদার ঘন কালো ছায়া! উপনির্বাচনে তৃণমূলের হার মানেই তার ব্যাখ্যা হবে দুর্নীতির ছায়ায় শাসক দলের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। এই বিড়ম্বনা আটকাতেই চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছে না তৃণমূল। তার মধ্যে দুই কেন্দ্রেই তৃণমূলের লড়াই কঠিন, এই মর্মে গোয়েন্দা রিপোর্ট হাতে আসার পর থেকে আরও সক্রিয় হয়েছেন শাসক দলের নেতৃত্ব। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “সারদা-কাণ্ড নিয়ে বিরোধীদের হইচইয়ের মধ্যে এর আগেও পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোট হয়েছে। তাতে আমাদের ফলে প্রভাব পড়েনি। কিন্তু এখন বিরোধী ও সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার আরও তুঙ্গে! খারাপ ফল হলে লোকসভা ভোটে জালিয়াতি হয়েছিল বলে তারা নতুন করে বাজারে নেমে পড়বে!”
বস্তুত, লোকসভা ভোটে তৃণমূল যে ভাবে ‘কাজ’ করেছিল, সেই সুযোগ যাতে উপনির্বাচনেও তারা না পায়, সেই দাবি নিয়েই নির্বাচন কমিশনের কাছে দরবার করছে বিরোধীরা। আগের দিন দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুখতার আব্বাস নকভির পরে মঙ্গলবার বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে এ রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ফের রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) সুনীল গুপ্তের কাছে গিয়ে দাবি করেছেন, লোকসভা নির্বাচনের মতো তৃণমূলকে যথেচ্ছ ‘ভোট লুঠ’ করার সুযোগ দেওয়া যাবে না! শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশলকে অপসারণের দাবিও তুলেছেন তাঁরা। কমিশন সূত্রের খবর, বনশলকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা।
একই দিনে সিইও-র দফতরে গিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, দুই কেন্দ্রেই তৃণমূল ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে। কংগ্রেসের প্রতিনিধিদল নিয়ে সিইও-র সঙ্গে সাক্ষাতের পরে অধীর বলেন, “শাসক দল দু’টি নির্বাচনী কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় দুষ্কৃতীদের এনে মোতায়েন করেছে। আমরা কমিশনকে জানিয়েছি, গত লোকসভা ভোটে যেমন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে রাজ্য সরকার নিজেদের মতো করে কাজে লাগিয়েছে, এ বার যেন তা না হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে কমিশনের পর্যবেক্ষকরা রাজ্যের উপরে নির্ভর করলে ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে না।” বসিরহাটে তৃণমূলের দুষ্কৃতী জড়ো করার পরিকল্পনা নিয়ে অভিযোগ জানাতে সিইও-র দফতরে গিয়েছিলেন মানস মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উত্তর ২৪ পরগনার সিপিএম নেতারাও।
বিরোধীরা যখন কমিশনের উপরে চাপ রাখছে, দুই কেন্দ্রে তখন কী করছে তৃণমূল? দমদম, বরানগর, লেকটাউন, রাজারহাটের মতো উত্তর ২৪ পরগনার বেশ কিছু এলাকা থেকে কাউন্সিলর-সহ স্থানীয় তৃণমূল নেতা ও তাঁদের বাহিনী বেশ কিছু দিন যাবৎ ঘাঁটি গেড়েছে বসিরহাট ও তার আশেপাশে। এর পরে ভাঙড় এলাকা থেকে আরও মানবসম্পদ সেখানে আনার পরিকল্পনা আছে বলে প্রশাসনকে জানিয়েছে বিরোধীরা। জেলার প্রায় সব তৃণমূল বিধায়কই সেখানে। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাকি গোটা মন্ত্রিসভাই ওই কেন্দ্রের প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গোটা ব্যবস্থাপনা দেখভালের দায়িত্বে দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় (বালু) মল্লিক। খাস কলকাতার মধ্যে বলেই চৌরঙ্গি কেন্দ্র অনেক বেশি করে সংবাদমাধ্যমের নজরবন্দি। তবু সেখানেও শিয়ালদহ ও ধর্মতলা অঞ্চলে হোটেলে লোক জড়ো করা হচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। পুলিশ যাতে ওই সব এলাকায় নিয়মিত হোটেলে তল্লাশি চালায়, তার জন্য কমিশনেও দাবি জানিয়েছেন অধীরেরা। চৌরঙ্গির মধ্যে বিশেষত ৬২ ও ৬৩ নং ওয়ার্ড সংলগ্ন এলাকা নিয়ে বেশি চিন্তিত বিরোধীরা। প্রচারেই সেখানে তারা বাধা পাচ্ছে বলে অভিযোগ। ভোটের দিন ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা বিধায়ক ইকবাল আহমেদের বাহিনীই ‘টি-২০ খেলবে’ বলে আশঙ্কা করছেন বিরোধী নেতারা! এবং সেটাই হবে শাসক দলের জয়ের চাবিকাঠি।
তাঁর স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী বলে চৌরঙ্গি কেন্দ্রের রাজনৈতিক লড়াই অনেকটাই দেখভাল করছেন তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের সেনাপতি ইকবালই। ঠিক যেমন বসিরহাটে বালু। দু’জনেই অবশ্য এর মধ্যে কোনও অশান্তি বা গোলমালের চেষ্টার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তৃণমূল নেতা ইকবাল বরং এ দিন পাল্টা দাবি করেছেন, “আমার কাছে খবর আছে, চৌরঙ্গিতে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ থেকে গুন্ডা আনছে। দলের সভাপতি অমিত শাহ কলকাতায় এসে ওদের এ সব বলে গিয়েছেন! আমি ঠিক করেছি, রাজ্যপালকে ব্যাপারটা জানাব।” এমন দাবিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলেই উড়িয়েছে বিজেপি।
পক্ষান্তরে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর দাবি, বসিরহাট দক্ষিণে কোনও গোলমাল হবে না এবং তাঁরা ১৫-২০ হাজার ভোটে জিতবেন। তাঁর কথায়, “বসিরহাট দক্ষিণ মহকুমা এলাকায় আমরা আড়াইশোটা সভা করেছি। সিপিএম সেখানে করতে পেরেছে ১০টা, বিজেপি ৬টা। ওরা লোক পাচ্ছে না বলে সভা করতে পারছে না। এর থেকে প্রমাণ হয়, মানুষের কাছে কাদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি!” জ্যোতিপ্রিয়বাবুর ব্যাখ্যা, দলের জেলা সভাপতি হিসাবেই শিবির করে জেলার সব বিধায়ককে নিয়ে বসিরহাটে শিবির করে আছেন এবং ১১ তারিখ প্রচার শেষ হলেই বিকাল ৫টার মধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। তাঁর পাল্টা চ্যালেঞ্জ, “আমরাই বলেছি, অন্তত ৫০ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনী থাক। এক একটা বুথে ১০ জন করে জওয়ান দিলেও আপত্তি নেই! কিন্তু এখানে কমিশনের পরিদর্শক বিজেপি-র লোক হয়ে একপেশে কাজ করছেন।”
উপনির্বাচনে ৩৮ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনী আসবে বলে কমিশনকে ধন্যবাদ জানান বিজেপির সিদ্ধার্থনাথ। তিনি বলেন, “প্রতি বুথে দু’জন করে আধা সেনা থাকবেন। বসিরহাট দক্ষিণে ৩০ জায়গায় এবং চৌরঙ্গিতে ৭০টি জায়গায় ওয়েব ক্যামেরা থাকবে। এতে আমরা খুশি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy