আলিপুর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন বুদ্ধদেব কুণ্ডু।- নিজস্ব চিত্র
পুলিশের উপর শাসক দলের মাত্রাহীন ছড়ি ঘোরানোয় এখনই রাশ না টানলে আলিপুরের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে বলে মত লালবাজারের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, এ সবের জেরে বাহিনীরই ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অথচ যাঁদের জন্য এই পরিণতি, সেই নেতা-মন্ত্রীদের নাম আড়ালেই থাকছে বলে ক্ষোভ বাড়ছে বাহিনীর অন্দরে।
কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “আলিপুর, ভবানীপুর, পোস্তা, বড়তলা, পার্ক স্ট্রিটের মতো থানার ওসি পদে বসাতে আগে অভিজ্ঞ, পোড়খাওয়া ইনস্পেক্টরদের একটি তালিকা তৈরি করা হতো। শাসক দল বা বাহিনীর কোনও শীর্ষকর্তার সুপারিশ থাকত ঠিকই, কিন্তু ওই তালিকার মধ্যেই যা করার, করতে হতো।” আর এখন? ওই অফিসারের কথায়, “অভিজ্ঞতা-যোগ্যতা-দক্ষতা নয়, শাসক দল বা দলের কোনও প্রভাবশালী নেতার প্রতি আনুগত্যই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখন গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি হওয়ার মাপকাঠি।”
আলিপুর-কাণ্ডে ভাবমূর্তি যে ভাবে নষ্ট হয়েছে তা থেকে কলকাতা পুলিশকে বের করে আনতে কড়া কোনও পদক্ষেপ জরুরি বিভাগীয় ডিসি-দের কয়েক জন ইতিমধ্যেই সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন লালবাজারে। যে ভাবে আলিপুর থানার ওসি-র ভূমিকা নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে, তাতে তাঁর অপসারণ নিয়ে সরব হয়েছেন বেশ কয়েক জন আইপিএস অফিসার। লালবাজার সূত্রের খবর, ওই থানার ওসি বুদ্ধদেব কুণ্ডুর ভূমিকা খতিয়ে দেখে তাঁকে বদলি করার পক্ষপাতী বিভাগীয় ডিসি-দের অধিকাংশই। বুদ্ধদেববাবু পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার উপর ওই থানা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। তাই মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি থেকে ফেরার পরেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে লালবাজার সূত্রের খবর।
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে লালবাজারের শীর্ষকর্তারা জানতে পেরেছেন, শাসক দলের সমর্থকদের তাণ্ডব চলাকালীন থানাতেই ছিলেন ওই ওসি। অভিযোগ, তাণ্ডবকারীদের সামাল দেওয়ার কোনও চেষ্টাই তিনি করেননি। লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার কথায়, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছে থানা যেন কোনও ক্লাব ঘর। কলোনির বাসিন্দারা যে যার মতো ঢুকছেন এবং আটক ব্যক্তিদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ওসি সামনে থাকা সত্ত্বেও বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি। আর এক পুলিশকর্তার মতে, থানার ঠিক বাইরে বিক্ষোভকারীদের ঢিল ছুড়তে দেখেও আলিপুর থানার ওসি কোনও ব্যবস্থা নেননি। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, তিনি শুধু বিক্ষোভকারীদের থামানোর চেষ্টা করছেন। লালবাজারের ওই কর্তার মতে, ওসির উচিত ছিল নরম মনোভাব না দেখিয়ে বাহিনীকে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলা করা। তাতে পুলিশকে হেয় হতে হতো না।
বুদ্ধদেববাবু কী বলছেন? তাঁর ফোন এ দিন বেজে বেজে কেটে গিয়েছে। থানায় ফোন করলে বলা হয়েছে, “বড়বাবু কোর্টে গিয়েছেন।” আদালতে বিচারকের ভর্ৎসনার পরে বুদ্ধদেববাবুকে কার্যত মাথা হেঁট করে আদালত থেকে বেরোতে দেখা যায়। এর পরেও পুলিশের নিচুতলার আশঙ্কা, পুরমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্য এ বারও তাঁকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।
এই সব ওসি-দের আনুগত্যের নমুনা কেমন? গত ১২ মে, এই শহরে লোকসভা ভোটের দিন উত্তর কলকাতার একটি স্কুল তথা নির্বাচনী কেন্দ্রের সামনে সাতসকালে হাজির হয়ে এক ওসি-র প্রশ্ন ছিল, “আমাদের ছেলেরা সবাই এসে গিয়েছে তো?” অধস্তন এক অফিসার তাঁকে জানান, ডিউটিতে যাঁদের থাকার কথা, সেই পুলিশকর্মীরা সবাই এসেছেন। তাঁকে থামিয়ে ওই ওসি সামনে থাকা স্থানীয় তৃণমূল নেতাকে জিজ্ঞেস করেন, “ছেলেরা এসেছে কি না দেখুন।” অভিযোগ, অন্য থানায় থাকাকীলান ওই ওসিই শ্লীলতাহানির এফআইআর করতে আসা এক মহিলার উপরে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন অভিযুক্তদের সঙ্গে মিটমাট করে নিতে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, দক্ষিণ কলকাতার একটি থানার অতিরিক্ত ওসি থেকে এক ইনস্পেক্টরকে সরাসরি দক্ষিণ শহরতলির একটি থানার ওসি পদে বসানোয় বড় ভূমিকা নেন শাসক দলের এক সাংসদ। তৃণমূলেরই একাধিক কাউন্সিলর ওই ওসি-র কাছে বেআইনি পুকুর ভরাট, প্রকাশ্যে মদের ঠেক চলার ব্যাপারে থানার নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অভিযোগ জানাতে গেলে ওই ওসি তাঁদের বলেন, “আমাকে এখানে কে ওসি করে পাঠিয়েছেন, সেটা তো আপনারা জানেন। আমি তাঁকে ফোন করলে আপনাদের পক্ষে ভাল হবে?”
লালবাজারের এক কর্তার বক্তব্য, ইস্টার্ন সাবার্বন ডিভিশনের একটি থানার ওসি-র বিরুদ্ধে খোদ ডিসি একাধিক রিপোর্ট দিয়েছেন। সেই ওসি দিব্যি বহাল রয়েছেন রাজনৈতিক কারণে। আর এক অফিসারকে অতিরিক্ত ওসি পদমর্যাদা থেকে তুলে মধ্য কলকাতার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি থানায় ওসি করার পিছনেও রাজনৈতিক যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ। উত্তর-মধ্য কলকাতার এক তৃণমূল পরিবারের তিনি ঘনিষ্ঠ। আবার এক ওসি সম্পর্কে পুলিশ মহলে কথা চালু যে, দক্ষিণ কলকাতার একটি থানার ওসি থাকার সময়ে তিনি ওই এলাকায় বেআইনি নির্মাণের যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন। ওই অফিসার এখন দক্ষিণ কলকাতার অন্য একটি থানার ওসি। লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতার দুই প্রভাবশালী ওসি-র এক জনের চাপে লালবাজারের শীর্ষকর্তারা বাধ্য হয়েছেন তাঁকে সেখানে রাখতে।
কলকাতা পুলিশের এক পোড় খাওয়া যুগ্ম-কমিশনারের বক্তব্য, শাসক দলের প্রতি পুলিশের এক শ্রেণির অফিসারদের আনুগত্য সব সময়েই ছিল এবং সে জন্য তাঁদের অনেকেই কমবেশি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথায়, “তখন ভাল পোস্টিং পাওয়ার ক্ষেত্রে পার্টির বা উচ্চপদস্থ কোনও অফিসারের সঙ্গে সুসম্পর্ক কাজে লাগত। তবে এখন যেমন অমুক দাদা বা তমুক নেতার লোক হয়ে গেলে সাত খুন মাপ হয়ে যাচ্ছে, সেটা তখন এত ঢালাও ভাবে হতো না।” যেমন, প্রাক্তন এক মহিলা এমএলএ-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দৌলতে সে আমলে এক অফিসার বরাবরই ওসি হিসেবে ভাল পোস্টিং পেয়ে এসেছেন। বছর সাতেক আগে ওই অফিসার যখন মধ্য কলকাতার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি থানার ওসি, সে সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে যত্রতত্র বেআইনি নির্মাণে মদত দেওয়ার অভিযোগ পান পুলিশ কমিশনার। প্রাথমিক ভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরে তৎকালীন সিপি তাঁকে সরিয়ে দিতে কালবিলম্ব করেননি।
কলকাতা পুলিশের এক সিনিয়র ইনস্পেক্টরের বক্তব্য, কলকাতা পুলিশে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ওসি-র সংখ্যা আগে কম ছিল না। তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে প্রশাসনের শীর্ষমহল কিংবা শাসক দলের শীর্ষনেতাদের যথেষ্ট দহরম-মহরমও ছিল। কিন্তু সেই পরিচিতির সুযোগ নিয়ে সেই ওসি-রা নিজেদের তাবের অফিসারদের ঢাল এক যুগ্ম কমিশনারের কথায়, “আগে পার্টির একটা নির্দিষ্ট ‘কোটা’ থাকত থানার ওসি বা অতিরিক্ত ওসি-দের বহাল করার ক্ষেত্রে। এখন কোটা-টোটা নয়, সবটাই অবাধ পার্টিরাজ। ফলে, আলিপুর থানায় টেবিলের তলায় ফাইলে মুখ ঢেকে কনস্টেবলের লুকোনোটাই ভবিতব্য।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy