বাঘের ঘরে পর্যটনের বাসা নৈব নৈব চ।
এই ফরমান নতুন নয়। তবে মানছে কে? গত অক্টোবর মাসে রাজ্য পর্যটন নিগমের ঝড়খালির হেড়োভাঙা নদীর কোলে ট্যুরিস্ট-হাব গড়ার প্রস্তাবে সরাসরিই ‘না’ বলে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রক। আকাশ পথে বাঘ দেখার প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রক। পর্যটন-পরিকল্পনা কতটা পরিবেশ বান্ধব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল পরিবেশপ্রেমী সংস্থাগুিও।
তবে রাজ্য সরকার সে সবের তোয়াক্কা করছে না বলেই ফের অভিযোগ তুললেন কেন্দ্রীয় পরিবেশ সংস্থার ও ঝড়খালির স্থানীয় বাসিন্দারা।
ট্যুরিস্ট হাবের প্রশ্নে ঝড়খালির আশপাশের গ্রামের মানুষ আশার আলো দেখলেও তাঁরা জানেন, পরিবেশ ক্ষুণ্ণ করে কিছু করা মানেই অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুযোর্গকেই ডেকে আনা। ঝড়খালি পঞ্চায়েত প্রধান বিজেপি-র দিলীপ মণ্ডলের প্রশ্ন, “ট্যুরিস্ট হাব হলে কর্মসংস্থানের দরজা খুলবে বলে যে প্রচার করছে সরকার তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তা-ছাড়া জল-জঙ্গলকে আঘাত করে কিছু করা মানে আরও একটা আয়লার পথ প্রশস্ত করা।” এই ‘সহজ সত্য’টা কেন পর্যটন নিগম বুঝতে চাইছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। সুন্দরবনকে প্রায় হাতের তালুর মতো চেনেন বাসন্তীর বাম-বিধায়ক সুভাষ নস্কর। তাঁর আক্ষেপ, “ঝড়খালিতে যে ঠিক কী করতে চাইছে রাজ্য সরকার বুঝতে পারছি না। কোনও পরিকল্পনা তো আমাদের জানিয়ে করার প্রয়োজন মনে করে না রাজ্য সরকার।” তাঁর পরামর্শ, ঝড়খালির প্রকল্প যেন পরিবেশ বিধি ‘লঙ্ঘন’ করে না হয়।
ঝড়খালির পর্যটন-হাব গড়ার প্রাথমিক খসড়া পাশ হয়েছিল পূর্বতন পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর হাতে। ওই দফতরের বর্তমান মন্ত্রী ব্রাত্য বসু সোজা সাপটা বলছেন, “সুন্দরবনে পর্যটনের আকর্ষণ বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী বেশ কিছু প্রকল্প নিয়েছেন। ঝড়খালির প্রকল্প তারই একটি। এতে সুন্দরবনের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি হবে।” কিন্তু তা করতে গিয়ে বাঘের ঘরে থাবা পড়বে না তো?
বিদ্যাধরী, হেড়োভাঙা আর মাতলা--তিন নদীর ঘেরাটোপে প্রান্তিক জনপদ ঝড়খালি। সুন্দরবনের গহিন এই এলাকাটিকে দেশের পর্যটন মানচিত্রে ঠাঁই দিতে সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ‘ট্যুরিস্ট হাব’-এ থাকছে বিলাসবহুল থেকে সর্বসাধারণের জন্য বিবিধ মানের হোটেল, বিলাসবহুল নৌভ্রমণ এমনকি আকাশ পথে সুন্দরবন ভ্রমণেরও সুযোগও।
কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্পটির রূপরেখা তৈরি করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই হেড়োভাঙা নদীর কোলে বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল ছেঁটে ফেলা হয়েছে বলে স্থানীয় পঞ্চায়েতের অভিযোগ। স্থানীয় গ্রামবাসীদের অভিযোগ, সাপ-নিধন করতে ব্যবহার করা হয়েছে যথেচ্ছ অ্যাসিডও। যার প্রভাব পড়েছে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে। জীব বৈচিত্রে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব বন্যপ্রাণ তহবিল বা ডব্লুডব্লুএফ। এ বার, তা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিল বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি’ বা এনটিসিএ।
ডব্লুডব্লুএফ-এর সুন্দরবনের দায়িত্বে রয়েছেন অনুরাগ দন্ড। তাঁর প্রশ্ন, “সদ্য বাঘসুমারিতে দেখা গিয়েছে হেড়োভাঙা রেঞ্জে বাঘের সংখ্যা যথেষ্ট। ওই এলাকায় বড় মাপের ট্যুরিস্ট হাব মানেই পশুদের একান্ত জীবনযাপন বিঘ্ন হওয়া।” তিনি জানান, পর্যটকদের মন পেতে খাঁড়িতে ঘন ঘন লঞ্চ ঢুকলে বা সুন্দরবনের আকাশে কপ্টার উড়লে ঠিকানা বদলাবে ব্যাঘ্রকুলও।
ঝড়খালির আকাশে কপ্টার উড়বে শুনে অসামরিক বিমানমন্ত্রকের প্রশ্ন, বাংলাদেশ সীমান্ত লঙ্ঘন হবে না তো? কারণ, সীমান্তবর্তী জেলায় ৫ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই উড়ান সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। এটাই সরকারি বিধি। ঝড়খালির অদূরে বাংলাদেশ সীমান্ত। নিতান্ত জরুরি ক্ষেত্র ছাড়া ওই সীমানা লঙ্ঘন করতে হলে প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকারের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) অনুমতি। ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশনের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “ঝড়খালির কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই বাংলাদেশের জল-সীমা। ওখানে হেলিকপ্টার উড়লে সীমানা লঙ্ঘনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আকাশ পথে প্রমোদ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এটিসি ওই সীমানা লঙ্ঘন অনুমোদন করবে না।” সম্প্রতি ওই এলাকা সরেজমিন ঘুরে এসেছেন খোদ পর্যটনমন্ত্রী। যে বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে এলাকায় হাব গড়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা, ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ শুরু করতে চলেছে তারাও। পর্যটন প্রসারের এই প্রবল কর্মযজ্ঞে পরিবেশের উপরে যে থাবা পড়বে তা নিয়ে সংশয় নেই বিশেষজ্ঞদের। বিরক্ত ব্যাঘ্রকুলও কি তাই এ বার ঠিকানা বদলাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy