ইডি দফতরে শঙ্কুদেব পণ্ডা। সোমবার। ছবি: শৌভিক দে
মুখ ঢাকা চাদরে! পুলিশের স্টিকার সাঁটা মোটরবাইকে মুখ লুকনোর মরিয়া চেষ্টা করতে করতে তিনি ঢুকলেন!
শঙ্কুস্যার!
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কলেজ-অধ্যক্ষেরা এই সে দিনও সদা তটস্থ থাকতেন তাঁর জঙ্গি আন্দোলনের ভয়ে। চোখ-মুখ দিয়ে আগুন ঝরিয়ে তিনি প্রকাশ্যে হুমকি দিতেন, শাসকদলের বিরোধিতা করা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বুঝে নেবেন ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে।’ কিন্তু সারদা তদন্তে ইডি-র তলব পেয়ে সেই শঙ্কুদেব পণ্ডাই এ দিন কি না মুখ ঢাকছেন!
তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। সিজিও কমপ্লেক্সে ঝড়ের গতিতে ঢুকল একটা লাল মোটরবাইক। সামনে ইংরেজিতে ‘পুলিশ’ লেখা। চালক-সহ তিন আরোহী। যদিও পুলিশের যানশাসন আইনে মোটরবাইকে দু’জনের বেশি সওয়ার হওয়া অপরাধ। উপরন্তু চালক ছাড়া কারও মাথায় হেলমেট নেই। সেটাও নিয়মবিরুদ্ধ। মাঝখানে বসা আরোহী কালো চাদরে মুখ ঢেকে রেখেছেন। দু’চাকাটি বলিউডি কায়দায় চোখের পলকে সিজিও কমপ্লেক্সে ঢুকে গেল। মাঝের সওয়ারি চাদর মুড়ি অবস্থাতেই লাফ দিয়ে নামলেন। মুখ থেকে চাদর একটু সরতেই বোঝা গেল, তিনি শঙ্কুদেব। তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা তাঁকে প্রশ্ন করতে চেয়ে দৌড়ে লিফ্ট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেখানেও চমক! কী রকম?
সিজিও কমপ্লেক্সের সাততলায় ইডি-র অফিস। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে লিফ্ট রয়েছে সেখানে পৌঁছনোর জন্য। দু’টি লিফ্ট থাকলেও অধিকাংশ সময়ে সেগুলো উপরে কোথাও আটকে থাকে। আগেও সারদা-তদন্তে সিবিআই বা ইডি যাঁদের তলব করেছে, অনেক সময়ে তাঁদের লিফ্টের দরজার সামনে অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু শঙ্কুদেবের বেলায় অন্য ব্যবস্থা! খোলা লিফ্ট তাঁর অপেক্ষায়! এবং তিনি ঢোকার আগে লিফ্ট যাতে বন্ধ না-হয়, সে জন্য এক পুলিশ লিফ্টের দরজার মাঝে পা রেখে দাঁড়ানো!
শঙ্কুদেব উঠতেই লিফ্ট ছেড়ে দিল। সাংবাদিকেরা যত ক্ষণে সিঁড়ি উজিয়ে সাততলায় উঠলেন, তত ক্ষণে শঙ্কুদেব ইডি অফিসে ঢুকে গিয়েছেন।
সারদা-মামলায় এ যাবৎ সিবিআই বা ইডি-র অফিসে তলব পেয়ে প্রায় সবাই এসেছেন গাড়িতে। পুলিশ প্রহরাতেই সিবিআই বা ইডি দফতরে ঢুকেছেন। কেউ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, কেউ দেননি। কেউ আবার সাংবাদিকদের এড়াতে অন্য দরজা দিয়ে ঢুকেছেন। কিন্তু মোটরবাইকে চড়ে এমন নাটকীয় প্রবেশ? এ শঙ্কুস্যারেরই কেরামতি!
বিরোধীরা নানা কথা বলছেন। বিজেপি নেতা তথাগত রায় বললেন, “আশ্চর্য লাগছে! উনি (শঙ্কুদেব) তো অসীম সাহসী লোক। তিনি কেন ঘাবড়ে গেলেন? কিছু কি লুকোনোর চেষ্টা করছেন?” সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “এদের আগে লজ্জাবোধ ছিল না। এখন বুঝেছে, কী অপরাধ করেছে। আগে বুকে পোস্টার লাগিয়ে ঘুরত। এখন শালে মুখ ঢাকছে।” কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের বক্তব্য, “অপরাধীরা মাথা উঁচু করে যেতে পারে না। এরা এত অপরাধ করেছে, তাই মুখ ঢেকে অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করছে।”
শঙ্কুর দলের কী বক্তব্য?
তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শঙ্কুকে আমি দেখিনি। কী করেছে, না-দেখে বা না-জেনে মন্তব্য করতে চাই না।” কিন্তু ‘পুলিশ’ লেখা মোটরবাইকে চড়ে সিজিও কমপ্লেক্সে শঙ্কুর প্রবেশ ও কড়া পুলিশি ঘেরাটোপে তাঁর প্রস্থানের ব্যাখ্যা কী? পার্থবাবুর জবাব, “শঙ্কু যদি পুলিশি পাহারায় বেরিয়েও থাকে, তা হলে অসুবিধে কী? ও তো চোর-ডাকাত নয় যে, সব ছেড়ে দিয়ে যেতে হবে!”
কিন্তু পুলিশই বা কেন শঙ্কুকে নিজেদের মোটরবাইকে চাপিয়ে সিজিও কমপ্লেক্সে পৌঁছে দিল? তা-ও আইন ভেঙে? তিন সওয়ারি নিয়ে, হেলমেট ছাড়াই? বিধাননগরের পুলিশ দাবি করছে, আইনবিরুদ্ধ কিছু হয়ে থাকলে প্রয়োজনে মামলা রুজু হবে। বিধাননগর কমিশনারেটের এডিসিপি দেবাশিস ধর এ দিন বলেন, “শঙ্কুবাবু সরকার থেকেই চার জন দেহরক্ষী পেয়েছেন। কনস্টেবল পদমর্যাদার ওই চার দেহরক্ষীর মধ্যে কারও মোটরবাইকে চড়ে তিনি হয়তো সিজিও কমপ্লেক্সে গিয়ে থাকতে পারেন।” আর আইনভঙ্গ প্রসঙ্গে এডিসিপি-র বক্তব্য, “ব্যাপারটা আমরা খতিয়ে দেখব। দরকারে মামলাও রুজু করা হতে পারে।”
বেলা তিনটে নাগাদ শঙ্কুদেব যখন সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরোচ্ছেন, তখন অবশ্য তাঁর অপেক্ষায় একটি এসইউভি দাঁড়িয়ে ছিল, কমপ্লেক্সের একেবারে সিঁড়ির গা ঘেঁষে। যাতে শঙ্কু বেরিয়েই গাড়িতে উঠে যেতে পারেন। পুলিশ সূত্রের খবর, গাড়িটা শঙ্কুদেবের নিজের। পুলিশি প্রহরায় শঙ্কু বাইরে বেরিয়েই লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। কেন তিনি চাদরমুড়ি দিয়ে লুকিয়ে এলেন? কেনই বা এ ভাবে কার্যত পালিয়ে যাচ্ছেন? ইডি তাঁকে কী জিজ্ঞেস করল?
শঙ্কুদেবের মুখে কুলুপ। তিনি গাড়িতে উঠতেই সেটি এত জোরে চলতে শুরু করল যে, ছিটকে গেলেন সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিক, এমনকী পুলিশরাও। দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন গাড়ির সামনে থাকা কয়েক জন। পুলিশ ও শঙ্কুদেবের কয়েক জন অনুগামীর সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ধস্তাধস্তিও বেধে গেল। এক পুলিশ অফিসারের মোবাইল মাটিতে পড়ে গিয়ে স্ক্রিনে চিড় ধরল। এক পুলিশ অফিসারের উর্দিতে লেখা নাম সংবলিত ব্যাজ ছিঁড়ে পড়ল মাটিতে। ছোটখাটো এক ঝড়ই তুলে দিয়ে গেলেন শঙ্কু!
ইডি সূত্রের খবর, দু’টি সংবাদ চ্যানেল ও একটি সংবাদপত্রের কর্তা হিসেবে শঙ্কুদেব সারদা থেকে নিয়মিত মোটা টাকা পেতেন। তাঁকে মাঝে-মধ্যে সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে দেখা যেত। সংবাদমাধ্যমের কাজের বাইরেও সারদা থেকে তাঁকে টাকা দেওয়া হতো বলে ইডি-র তদন্তকারীদের দাবি। এ দিন শঙ্কুদেব তাঁর কিছু আর্থিক লেনদেনের নথিপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। ইডি-র একাংশের দাবি, কোনও কোনও প্রশ্নের সামনে শঙ্কুদেবকে যথেষ্ট অপ্রতিভই দেখিয়েছে। তাঁকে সাড়ে তিন ঘণ্টা জেরা করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাঁকে আবারও ডাকা হতে পারে বলে ইডি সূত্রের খবর।
শঙ্কুদেব ইডি’তে যাওয়ার খানিক আগে এ দিন সিজিও কমপ্লেক্সেই সিবিআই দফতরে ঢুকেছিলেন ‘কলম’ পত্রিকার এক সময়ের প্রকাশক ও মুদ্রক আমিনউদ্দিন সিদ্দিকী। তাঁকে দু’দফায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা জেরা করে সিবিআই। আবার এ দিনই সিবিআই অফিসে ডাক পড়েছিল সল্টলেকের এক পাঁচতারা হোটেলের এক পদস্থ কর্তার। সিবিআইয়ের দাবি, ২০১১-র সরকারি চলচিত্র উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের যে নৈশ পার্টির আয়োজন হয়, সারদা তার বিল মিটিয়েছিল। অথচ সারদা ওই চলচ্চিত্র উৎসবের স্পনসর ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে, চলচিত্র উৎসবের মতো সরকারি অনুষ্ঠানের টাকা সারদা মেটাল কেন? সিবিআই-সূত্রের খবর, এই সংক্রান্ত ব্যাঙ্ক-লেনদেনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতেই ওই হোটেল-কর্তার ডাক পড়েছিল। এ দিন বিকেলে প্রায় দেড় ঘণ্টা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy