অঙ্কন: সুমিত্র বসাক
তিন বছর আগেই মগজের সন্ধান দিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু এ রাজ্যে সেই অস্ত্রের ব্যবহার পুরোপুরি চালু হয়নি! কিন্তু সেই মগজের কার্যকারিতা বুঝেছিল লালবাজার। এ বার কেন্দ্রের ধাঁচেই নিজেদের তৈরি মগজাস্ত্র ব্যবহার করতে চায় তারা।
শহরের রাজপথ বা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কলকাতা পুলিশের বড়-মেজ-ছোটবাবুদের দাপট বহু বারই দেখা গিয়েছে। কিন্তু সেই দাপটের ফাঁকে থানায় নথিভুক্ত হওয়া বহু ঘটনারই হদিস পাচ্ছেন না শীর্ষ কর্তারা। এক থানা থেকে অন্য থানায় খবর যেতেও বহু দিন লেগে যাচ্ছে। তাই সমন্বয় বাড়াতে প্রতি থানায় এ বার আনা হচ্ছে ‘ক্রাইমবাবু’কে।
পুলিশ সূত্রের খবর, ‘ক্রাইমবাবু’ আদতে একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার। তার মগজেই ঠাসা থাকবে থানায় রেকর্ড হওয়া প্রতিটি ঘটনা। অপরাধীর বিবরণ, তদন্তের অগ্রগতি বা মামলার দিনক্ষণ সবই ‘ক্রাইমবাবু’র মগজে পুরে রাখবেন কর্মী-অফিসারেরা। প্রয়োজন মতো শীর্ষ কর্তারা সেগুলি দেখে নিতে পারবেন। বাড়বে এক থানার সঙ্গে অন্য থানার সমন্বয়ও। কিন্তু কেন এই সফটওয়্যারের দরকার পড়ল? তা হলে কি কলকাতা পুলিশের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে?
সমন্বয়ের অভাব যে রয়েছে, তা অবশ্য ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিচ্ছেন লালবাজারের অনেক কর্তাই। তার উদাহরণ দিতে গিয়েই এক জন বললেন, “একবালপুর থানা এলাকায় মাস কয়েক আগে দুই মেয়ে-সহ এক জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছিলেন। থানায় নিখোঁজ ডায়েরি হলেও তা লালবাজার বা অন্য থানায় সে ভাবে জানানো হয়নি। দু’সপ্তাহ পরে থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটি দোকানের মেঝে খুঁড়ে তিন জনের দেহ উদ্ধার হয়। খুনের অভিযোগে ধরা পড়ে থানার অফিসারদের একাংশের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় কয়েক জন যুবক।” লালবাজারের অন্দরের খবর, শুধু একবালপুরই নয়, শহরের বহু থানাতেই এমন সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একবালপুরের ঘটনা সামনে এসেছিল বলেই তা নিয়ে হইচই হয়েছে। “এ বার সমন্বয় বাড়াতেই এই নতুন সফটওয়্যারের আমদানি করা হয়েছে। অফিসারদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।” বলছেন লালবাজারের আধুনিকীকরণের দায়িত্বে থাকা এক শীর্ষ কর্তা।
‘ক্রাইমবাবু’ নিয়ে কলকাতা পুলিশের কর্তারা উচ্ছ্বসিত হলেও রাজ্য পুলিশের অনেকেই বলছেন, জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর ‘ক্রাইম অ্যান্ড ক্রিমিনাল ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ক অ্যান্ড সিস্টেমস’ (সিসিটিএনএস)-এর অধীনেই এই প্রকল্প চালু হওয়ার কথা ছিল। ২০১১ সালে সেই প্রকল্প চালু হলেও এখনও রাজ্যে তা চালু হয়নি। পুলিশের একাংশের মতে, ‘ক্রাইমবাবু’ শুধু কলকাতা পুলিশ এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এখানে শহর ও শহরতলি যে ভাবে মিশে রয়েছে, তাতে শহরতলির দুষ্কৃতীদের হদিস না রাখলে সমস্যা তৈরি হবে। দক্ষিণ শহরতলির এক পুলিশকর্তা বলছেন, “বহু সময়েই দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুষ্কৃতীরা কসবা বা যাদবপুরে এসে অপরাধ করে পালায়। কিন্তু তাদের হদিস পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়।” এই প্রসঙ্গেই সিসিটিএনএস প্রকল্পের কথা বলেছেন পুলিশের একাংশ। তাঁরা বলছেন, বহু রাজ্যে চালু হলেও এ রাজ্যে সিসিটিএনএস চালু করা নিয়ে প্রশাসনের মাথাব্যথা নেই। কেন? রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, এ রাজ্যেও সিসিটিএনএস প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে চলছে। বিভিন্ন জেলা ও সংস্থার মধ্যে পরীক্ষামূলক ভাবে তা চালুও হয়েছে। কিন্তু কবে থেকে সারা রাজ্যের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সংযোগ স্থাপন হবে, তা নিয়ে নিশ্চিত নন রাজ্য পুলিশের কর্তারা।
পুলিশের একাংশের মতে, সিসিটিএনএস একটি জাতীয় প্রকল্প। সেই সফটওয়্যারে গোটা দেশের নথি থাকত। ফলে দেশের যে কোনও প্রান্তের পুলিশই অন্য রাজ্যের পুলিশের নথি দেখতে পারত। কোথায় কী অপরাধ হয়েছে, তারও খতিয়ান নিতে পারত। এ সবের মধ্যে রাজ্যের অপরাধপঞ্জী জাতীয় ব্যবস্থার সঙ্গে জুড়ে গেলে রাজ্যের অপরাধ-নথি আরও প্রকাশ্যে চলে আসত।
লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতা পুলিশের ৬৯টি থানা, গোয়েন্দা বিভাগের ৩৫টি শাখা, ট্রাফিক বিভাগের ২৫টি গার্ড এবং অন্যান্য শাখায় প্রতিদিনের দায়ের করা বিভিন্ন অভিযোগ ওই ‘সফটওয়ার প্যাকেজ’-এ আপলোড করা হচ্ছে। রেকর্ড হওয়া অপরাধের ঘটনা এখন মাউসে ক্লিক করলেই ‘ক্রাইমবাবু’র মাধ্যমে জেনে নিতে পারবেন থানার আধিকারিক থেকে লালবাবাজারের বড় কর্তারা। অপরাধের বিবরণ জানার জন্য এখন আর থানা আধিকারিকদের ফোন বা মেসেজের অপেক্ষায় থাকতে হবে না পুলিশকর্তাদের। ইতিমধ্যেই কলকাতা পুলিশের আটটি ডিভিশনের থানা আধিকারিকদের ওই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, প্রতিটি থানায় এক জন করে অফিসার প্রতিদিনের ঘটনার বিবরণ রিপোর্ট আকারে ‘ক্রাইমবাবু’তে নথিবদ্ধ করবেন। কলকাতা পুলিশ বছরখানেক ধরে ওই ‘সফটওয়্যার’ ব্যবহার করা শুরু করলেও চলতি মাস থেকেই সবার জন্য তা বাধ্যতামূলক করা গয়েছে বলে লালবাজার সূত্রের খবর।
কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “কোনও অপরাধীর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে ‘ক্রাইমবাবু’তে সার্চ করলেই বেরিয়ে আসবে অপরাধীর বিস্তারিত বিবরণ। যা আমাদের নিজেদের আপডেট থাকতে সাহায্য করবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy