প্যারেডে ব্যস্ত সেই ট্র্যাফিক কনস্টেবল তারাগতি বিশ্বাস। ছবি: শৌভিক দে।
একই পুলিশ, একই দায়িত্ব। অথচ কোথাও সে আগ বাড়িয়ে বিতর্কিত রকমের সক্রিয়। কোথাও আবার গুরুতর অভিযোগ পেয়েও সন্দেহজনক ভাবে নিষ্ক্রিয়!
আইনরক্ষকের এ হেন দ্বিচারিতার পিছনে রাজনৈতিক প্রতিপত্তিই মূল কারণ কি না, পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং বারবার সে প্রশ্ন উঠেছে। খাস কলকাতায় শাসকদলের সাংসদের হাতে ট্র্যাফিক পুলিশ নিগ্রহের সাম্প্রতিকতম ঘটনাটির মধ্যে সেই ধারাবাহিকতাই বজায় রইল বলে পুলিশের নিচুতলার অভিযোগ। এই মহলের মতে, অম্বিকেশ বা শিলাদিত্য-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে ঘটনাটিকে বিচার করলেই স্পষ্ট হয়, রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসনের রাজনৈতিক পক্ষপাত কোন মাত্রায় পৌঁছেছে!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র কিংবা জঙ্গলমহলের যুবক শিলাদিত্য চৌধুরীর ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তের ধার ধারেনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল নেতা মুকুল রায়কে নিয়ে কার্টুন পোস্ট করার অভিযোগ ছিল অম্বিকেশবাবুর বিরুদ্ধে। আর জনসভার মঞ্চ থেকে শিলাদিত্যের গায়ে ‘মাওবাদী’ তকমা লাগিয়ে দেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনই সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু ট্র্যাফিক পুলিশকে চড় মারার মতো গুরুতর অভিযোগে জামিন-অযোগ্য ধারায় যাঁর নামে মামলা রুজু হয়েছে, তৃণমূলের সেই সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে পুলিশের সেই তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ঘটনার ছত্রিশ ঘণ্টা বাদেও গ্রেফতার দূরস্থান, সাংসদকে ডেকে এক বারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদও করেনি বিধাননগর পুলিশ! কেন করেনি?
বিধাননগর কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসিপি) দেবাশিস ধর বৃহস্পতিবার বলেন, “আমরা তদন্ত করে দেখছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান রেকর্ড করা হচ্ছে।”
বুধবার দুপুরে প্রসূনবাবু নিজের গাড়িতে লেকটাউন থেকে বাঙুরের দিকে যাচ্ছিলেন। অভিযোগ: লেকটাউন মোড়ে ‘নো ইউ-টার্ন’ বোর্ড সত্ত্বেও চালক ‘ইউ টার্ন’ নিতে যান। কর্তব্যরত ট্র্যাফিক কনস্টেবল তারাগতি বিশ্বাস গাড়ি আটকান। বচসা বাধে। প্রসূনবাবু তখন গাড়ি থেকে নেমে ওই পুলিশকর্মীর উপরে শুধু চোটপাটই করেননি, তাঁকে ধাক্কা মেরে সপাটে চড় কষিয়ে দেন বলে অভিযোগ। প্রসূনবাবু বচসার কথা মেনে নিলেও ধাক্কা বা থাপ্পড় মারার কথা অস্বীকার করেছেন।
বুধবার রাতেই পুলিশ তারাগতিবাবুকে দিয়ে অভিযোগ দায়ের করিয়েছিল। কর্তব্যরত সরকারি কর্মীর কাজে বাধাদান ও মারধরের অভিযোগে এ দিন প্রসূনবাবুর নামে মামলা রুজু হয়, যার দ্বিতীয়টি জামিন-অযোগ্য। দিনের শুরুতে এ হেন পদক্ষেপ দেখে পুলিশের নিচুতলার ধারণা হয়েছিল, এ বার বুঝি নবান্ন থেকে ‘রাজধর্ম’ পালনের নির্দেশ এসেছে কর্তাদের কাছে। তবে বেলা গড়াতেই মালুম হয়েছে, ধারণাটা ভুল। অভিযুক্তকে তলব না-করে নিগৃহীত কনস্টেবলের সহকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই সারা দিন পার করে দিয়েছে বিধাননগরের পুলিশ।
এমতাবস্থায় বিরোধী দলের মতো পুলিশের নিচু স্তরেও অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। উঠে আসছে অম্বিকেশ-শিলাদিত্য প্রসঙ্গ। “কোনটা যে আইন, কখন যে কাকে গ্রেফতার করতে হবে, সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে!’’ মন্তব্য লেকটাউন থানার এক কনস্টেবলের। মাস কয়েক আগে বোলপুর থানায় তাণ্ডব চালিয়েও অভিযুক্ত তৃণমূল যুবনেতা কী ভাবে পার পেয়ে গিয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গও বাদ যাচ্ছে না ওঁদের আলোচনায়। তারাগতিবাবুর সহকর্মীদের অনেকের প্রশ্ন, “এর পরে তো রাস্তায় যে কেউ আমাদের চড়-থাপ্পড় মেরে যাবে! ধসে পড়া আত্মবিশ্বাস ফেরাবে কে?” এডিসিপি দেবাশিস ধরের অবশ্য দাবি, “তদন্তে কোনও ঢিলেমি নেই। ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ছিল না। তাই ছবি পাওয়া যায়নি। ঠিক কী ঘটেছিল, প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া তার কোনও সাক্ষী নেই।”
তাই ঘটনার সময়ে আশপাশে ডিউটিতে থাকা দু’-এক জন কনস্টেবলের বয়ান রেকর্ড করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেবাশিসবাবু। যদিও সাধারণ পুলিশকর্মীদের অনেকের মতে, এ ক্ষেত্রেও তদন্তের নামে স্রেফ সময় নষ্ট করা হচ্ছে। বস্তুত এ দিন বিধাননগর কমিশনারেট প্রসূনবাবুর বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করার পরেই তৃণমূল-সূত্রে বলা হয়েছিল, প্রসূনবাবু আগাম জামিনের আবেদন করতে পারেন। তার পরেই পরিষ্কার হয়ে যায়, পুলিশ এ
দিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করবে না। রাতে প্রসূনবাবু হাওড়া কোর্টে এসে সরকারি আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। তাঁর কথায়, “আমি কিছু ভুল করিনি। আমি তৃণমূলের সাংসদ বলেই আমার বিরুদ্ধে সিপিএম ও কিছু লোক চক্রান্ত করছে।”
পাশাপাশি তারাগতিবাবুর ‘শারীরিক অসুস্থতা’র প্রসঙ্গও তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ। প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূনবাবুর দাবি, “ওই কনস্টেবল স্নায়ুরোগী। সহকর্মীরা জানিয়েছেন, ওঁর চিকিৎসা চলছে। ব্যাপারটা নিয়ে আমি পুলিশ কমিশনারেটের সঙ্গে কথা বলেছি।” তারাগতিবাবুর সহকর্মীরা কিন্তু মানছেন না যে, উনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ। সংশ্লিষ্ট লেকটাউন ট্র্যাফিক গার্ডের এক কর্তার যুক্তি, অসুখ থাকলে ওঁঁকে ভিআইপি রোডে লেকটাউনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ডিউটি দেওয়ার প্রশ্ন থাকত না। “বরং তারাগতিবাবু অত্যন্ত দায়িত্ববান কনস্টেবল। ওঁকে হামেশাই ওখানে ব্যস্ত সময়ে ডিউটি দেওয়া হয়। তিনি অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ভাবে ডিউটি করেন।” বলেছেন তিনি।
তারাগতি বিশ্বাস এ দিনও লেকটাউনের মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্র্যাফিক সামলেছেন। দুপুরে সহকর্মীদের সঙ্গে প্যারেডও করেছেন। শাসকদলের এমপি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলের ‘সাহস’ দেখানোর জন্য অপরিচিত মানুষজনও এসে তাঁকে বাহবা দিয়ে গিয়েছেন। নিজের প্রশংসা শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী?
তিনি নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে শুধু বলেছেন, “আমাকে আমার কাজটা করতে দিন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy