পুরভোটেও বহাল পঞ্চায়েতের ছবি!
রাজ্য সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ বিরোধ-পর্বে রাজভবন, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ঘুরে তবে পঞ্চায়েত ভোট করাতে পেরেছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। ১৭ পুরসভার আসন্ন ভোটও ফের সেই পথে হাঁটতে চলেছে বলে মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তা এবং রাজনীতিকদের একাংশ। কারণ, জুলাইয়ের মধ্যে ওই পুরসভাগুলির মেয়াদ শেষ হতে চললেও ভোট করানোর ব্যাপারে এখনও কোনও গা নেই রাজ্য সরকারের। অথচ, মে মাসের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা না হলে সময়ে ভোট করা সম্ভব নয়।
এই অবস্থায় শনিবার দুপুরে রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। সরকারি ভাবে কমিশনের তরফে এই বৈঠক নিয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে একাধিক সূত্রের খবর, পুরভোট নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা রাজ্যপালকে জানিয়ে এসেছেন মীরাদেবী। কমিশনের একটি সূত্রে আবার বলা হচ্ছে, চলতি মাসের শেষ দিন পর্যন্ত যদি রাজ্য সরকারের তরফে ভোট করানোর কোনও উদ্যোগ দেখা না যায়, তা হলে আদালতে যাওয়ার ভাবনা রয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে সেই সংক্রান্ত নথিপত্র তৈরির কাজও।
সময়ে পুরভোট করাতে শাসক দলের অনীহা কেন? বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে তৃণমূল ৩৪টি আসন পেলেও যে ১৭টি পুরসভায় ভোট আসন্ন, সেখানে বহু আসনেই পিছিয়ে রয়েছে তারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের টপকে গিয়েছে বিজেপি। আর তাই এখনই সেখানে পুরভোট করাতে অনিচ্ছুক তৃণমূল। কিছু সময় পেরিয়ে গেলে মোদী-ঝড়ের দাপট খানিকটা কমে আসবে, পুরবোর্ড দখলে রাখা সহজ হবে এমনটাই শাসক দলের অঙ্ক বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
এখন প্রশ্ন হল, রাজ্য সরকার কি পুরভোট ঠেকিয়ে রাখতে পারে? পুরভোটের দিনক্ষণ যে হেতু রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে রাজ্য সরকারেরই ঘোষণা করার কথা, সে হেতু তারা উদ্যোগী না-হলে কমিশনের পক্ষে ভোট করানো সম্ভব নয়। পুরভোট প্রসঙ্গে সংবিধানের ২৪৩(ইউ) ধারার এক নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্দিষ্ট সময়ের আগে পুরবোর্ড ভেঙে না দেওয়া হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত তার মেয়াদ কার্যকর থাকবে। আর তিন নম্বর অনুচ্ছেদ বলছে, পুরসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ছ’মাস আগে ভোট করা যাবে। কিন্তু আগের বোর্ডকে মেয়াদ শেষ করার সুযোগ দিতে হবে। অন্য দিকে, ১৯৯৩ সালের পশ্চিমবঙ্গ পুর-আইনে বলা হয়েছে, কোনও কারণে নির্ধারিত সময়ে ভোট না করা গেলে মেয়াদ শেষে সংশ্লিষ্ট পুর-বোর্ড আপনা থেকেই ভেঙে যাবে। তখন সরকার সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে। কিন্তু তা ছ’মাস করে দু’দফায় এক বছরের বেশি নয়। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যের শাসক দল সেই আইনি সুযোগটাই নিতে চাইছে।
সংবিধানের ২৪৩(ইউ) ধারা
• অনুচ্ছেদ ১: মাঝপথে ভেঙে না দিলে পুর-বোর্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর
• অনুচ্ছেদ ৩: মেয়াদ শেষের আগেই পরবর্তী নির্বাচন
পশ্চিমবঙ্গ পুর-আইনের ১৪ ধারা
• উপধারা চার: সময়ে ভোট না হলে বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
ছ’মাস করে সর্বোচ্চ দু’বার প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে সরকার।
কমিশন সূত্রে খবর, যথাসময়ে পুরভোটের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করতে বলে রাজ্যকে একাধিক বার চিঠি দিয়েছে তারা। তার জবাবে এ মাসেরই গোড়ায় পুরসচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দেন, ১৭টি পুরসভায় ভোটের দিন ঠিক করা নিয়ে রাজ্য সরকার এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। লোকসভা ভোট মেটার ক’দিন আগে কমিশন আবার চিঠি দেয় রাজ্যকে। কিন্তু এখনও তার জবাব মেলেনি।
বস্তুত, রাজ্য যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভোট করতে খুব একটা আগ্রহী নয়, তার ইঙ্গিত মিলেছে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কথাতেই। শনিবার তিনি বলেন, “আগেও অনেক পুরসভার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যা নিয়ম, তা-ই হবে। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ভোট হবে, বা হবে না, কোনওটাই বলছি না।”
শনিবার রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি মীরাদেবী। ফোন বন্ধ রেখেছেন। অন্য দিকে, রাজ্যপালের কাছে তাঁর যাওয়া প্রসঙ্গে পুরমন্ত্রীর বক্তব্য, “রাজ্যপালকে সম্মান করি। তিনি কী বলেন, শুনব। কেউ অভিযোগ জানাতেই পারেন। রাজ্যের উন্নয়নমূলক কাজ আটকে আছে। সেগুলো তো করতে হবে।” এই পরিস্থিতিতে শাসক দলের উপরে চাপ বাড়াতে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্যপালের কাছে দেখা করে পুরভোটের আর্জি জানিয়েছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, “লোকসভা ভোটে আমাদের প্রতি আমজনতার সমর্থন দেখে ভয় পেয়েছে তৃণমূল।” তাঁর বক্তব্য, জুলাইয়ের শেষে বর্তমান কমিশনার মীরা পাণ্ডের কার্যকাল শেষ হচ্ছে। তার আগে পুরভোট করতে চাইছে না রাজ্য সরকার। আর বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “গরম বা অন্য কোনও অজুহাত না-দেখিয়ে সরকারের উচিত সময়ে ভোট করা। এটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীও মনে করেন, “মমতার সরকার ভয় পেয়ে ভোট করাতে চাইছে না।” তাঁর মতে, জিতেও শাসক দল পরাজয়ের মানসিকতায় ভুগছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই আর ইডি তদন্তের আতঙ্ক। বিরোধীদের এ সব অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের বক্তব্য, লোকসভা বা বিধানসভা ভোট করানোর দায়িত্ব যেমন নির্বাচন কমিশনের, তেমনই পুরভোট করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। এ ব্যাপারে তৃণমূল মাথা ঘামাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy