Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
প্রসূনের চড়

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য নিতেই দিন কাবার পুলিশের

এ যেন আর এক উলটপুরাণ! যেখানে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তকে ছেড়ে অভিযোগকারীকে নিয়েই সময় কাটিয়ে দেয় পুলিশ! খাস কলকাতার বুকে শাসকদলের সাংসদের হাতে ট্র্যাফিক পুলিশ নিগ্রহের ঘটনার তদন্তের রকম-সকম দেখে পুলিশেরই অন্দরে এমন ধারণা। সংশ্লিষ্ট বিধাননগর পুলিশের অফিসার-কর্মীদের বড় অংশ বলছেন, অভিযুক্ত তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে জোর দেওয়ার বদলে কমিশনারেটের কর্তারা এখন অভিযোগকারী কনস্টেবল তারাগতি বিশ্বাসের অভিযোগটিকে ভুল প্রমাণ করতেই ব্যস্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১০
Share: Save:

এ যেন আর এক উলটপুরাণ! যেখানে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তকে ছেড়ে অভিযোগকারীকে নিয়েই সময় কাটিয়ে দেয় পুলিশ!

খাস কলকাতার বুকে শাসকদলের সাংসদের হাতে ট্র্যাফিক পুলিশ নিগ্রহের ঘটনার তদন্তের রকম-সকম দেখে পুলিশেরই অন্দরে এমন ধারণা। সংশ্লিষ্ট বিধাননগর পুলিশের অফিসার-কর্মীদের বড় অংশ বলছেন, অভিযুক্ত তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে জোর দেওয়ার বদলে কমিশনারেটের কর্তারা এখন অভিযোগকারী কনস্টেবল তারাগতি বিশ্বাসের অভিযোগটিকে ভুল প্রমাণ করতেই ব্যস্ত।

বুধবার নিজের গাড়িতে লেকটাউন থেকে বাঙুরের দিকে যাচ্ছিলেন প্রসূনবাবু। অভিযোগ, লেকটাউন মোড়ে ‘নো ইউ-টার্ন’ বোর্ড সত্ত্বেও চালক ইউ-টার্ন নিতে যান। কর্তব্যরত ট্র্যাফিক কনস্টেবল তারাগতিবাবু গাড়ি আটকান। বচসা শুরু হয়। সাংসদ গাড়ি থেকে নেমে তারাগতিবাবুর উপরে চোটপাট শুধু নয়, তাঁকে চড় কষিয়ে দেন বলে অভিযোগ। প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূনবাবু বচসার কথা স্বীকার করলেও ধাক্কা বা থাপ্পড় মারার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সরকারি কর্মীর কাজে বাধাদানের পাশাপাশি তাঁকে শারীরিক নিগ্রহের জামিন-অযোগ্য ধারায় প্রসূনবাবুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবু এখনও সাংসদকে গ্রেফতার দূরস্থান, ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করেননি বিধাননগর কমিশনারেটের কর্তারা। যা দেখে পুলিশের নিচু তলায় সন্দেহ ও অনাস্থা দানা বেঁধেছে। বিধাননগর ট্র্যাফিক পুলিশের এক অফিসারের কথায়, “তারাগতি বিশ্বাস ঠিক কথা বলছেন কি না, তা যাচাই করতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কমিশনারেটের কর্তারা তো জানেন, সে সময় ওখানে ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীদের কার অবস্থান কী ছিল!” কী ছিল?

ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দুপুর দু’টো নাগাদ লেকটাউন মোড়ে তারাগতিবাবু এক গ্রিন পুলিশের সঙ্গে ডিউটি করছিলেন। ঘটনার সময়ে ওই গ্রিন পুলিশ জল খেতে ট্র্যাফিক গার্ডে গিয়েছিলেন। কিছু অফিসার গার্ডের ভিতর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ওই ট্রাফিক গার্ড থেকে ঘটনাস্থল দেখা যায় না। গার্ডের কয়েক জন পুলিশকর্মী ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টরের সঙ্গে গিয়েছিলেন লেকটাউন মিলন সঙ্ঘের মাঠে, প্যারেড করতে। কয়েক জন কনস্টেবল লেকটাউনের পাশের মোড়ে ডিউটি করছিলেন। সেখান থেকেও ঘটনাস্থল দেখা যায় না।

তা হলে প্রত্যক্ষদর্শী রইলেন কারা?

শুক্রবার ঘটনাস্থলে ঘুরে দেখা গেল, রাস্তা লাগোয়া কিছু পান-সিগারেটের দোকান। যাঁরা জানালেন, কিছু দেখেননি। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক দোকানদার হাত জোড় করে বললেন, “এ সবে জড়াবেন না। ব্যবসা করে খাই। মারা পড়ব।” লেকটাউন ট্র্যাফিক গার্ডের এক অফিসারের পর্যবেক্ষণ, “লেকটাউন মোড়ে সিসিটিভি না-থাকার সুযোগে তারাগতিবাবুকেই মিথ্যাবাদী প্রমাণের চেষ্টা শুরু হয়েছে।”

বস্তুত প্রসূন-কাণ্ড ঘিরে বিধাননগর পুলিশের উপরতলার প্রতি নিচুতলার আস্থা ক্রমশ নিম্নগামী। বিধাননগর পুলিশের মাথারা যদিও তদন্তে গাফিলতি মানতে নারাজ। এডিসিপি দেবাশিস ধর এ দিন বলেন, “সবে মামলা শুরু হয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে আগে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান রেকর্ড করা হবে। তার পরে প্রয়োজনে প্রসূনবাবুকে ডাকা হবে।” আজ, শনিবার সাংসদের গাড়ির চালককে ডেকে পাঠানোর কথা হচ্ছে। তবে তদন্তকারীদের কথাবার্তায় পরিষ্কার, নবান্নের সবুজ সঙ্কেত না-পেলে সাংসদকে তলবের প্রশ্ন নেই। প্রসূনবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, পুলিশ ডাকলে তিনি যেতে তৈরি। “আইন আইনের পথে চলবে। আমি কোনও ভুল করিনি। আমি সুনাগরিক হিসেবে পুলিশকে সব সাহায্য করতে তৈরি। তবে একটু আগে থেকে জানিয়ে রাখলে সুবিধা হয়।” বলেছেন সাংসদ। তাঁর এ-ও দাবি, “আমার বিরুদ্ধে কিছু একটা চক্রান্ত চলছে।”

কিন্তু তারাগতিবাবুর সহকর্মীমহলের অভিযোগ, চক্রান্ত আসলে চলছে ওঁরই বিরুদ্ধে। তারাগতিবাবুকে ফাঁসানো হলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার হুঁশিয়ারিও শোনা গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের আর এক সাসংদ তাপস পালের উদাহরণ টেনে এক কনস্টেবলের মন্তব্য, “আপত্তিকর কথা বলার পরেও পুলিশ তাপসবাবুর নামে মামলা করেনি। জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করাতেই ওঁকে শেষমেশ ভবানী ভবনে, সিআইডি-র সদরে হাজির হতে হয়েছিল।”

এ দিন সকালে প্রসূনবাবুর গ্রেফতারের দাবিতে লেকটাউন থানা ঘেরাও করেন উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা কংগ্রেস কমিটি। তারাগতিবাবু এ দিনও সকালে লেকটাউন মোড়ে যথারীতি ডিউটি করেছেন। তার পরে চলে গিয়েছেন প্যারেড করতে।

অন্য বিষয়গুলি:

prasun bandyopadhyay tmc police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE