প্রকল্প হলে এলাকাই শুধু নয়, গোটা জেলার অর্থনীতির চেহারাই যে বদলে যেতে পারে। হবে বিপুল কর্মসংস্থানও। কিন্তু, আগে প্রশাসনকে এসে আলোচনায় বসতে হবে। জমি-জীবন ও জীবিকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ জানাতে হবে। তবেই, কয়লা তোলার জন্য তাঁরা রাজ্য সরকারকে জমি দিতে রাজি আছেন বলে জানিয়ে দিচ্ছেন পাঁচামি শিল্পাঞ্চলের মানুষজন।
তাঁদের এই বক্তব্যের পিছনে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ঘোষণা। সোমবার নবান্নে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারের নিজের জমিতেই হবে বারো হাজার কোটি টাকার কয়লা প্রকল্প। মহম্মদবাজার ব্লকের পাঁচামি-দেউচা এলাকায় মজুত থাকা ২২০ কোটি টন তুলতে জমি নিয়ে সমস্যা হবে না বলেই মুখ্যমন্ত্রীর দাবি। আর এই দাবির কথা শুনেই ধন্দ বেড়েছে বীরভূম জেলা প্রশাসনের। বাস্তব বলছে, এই এলাকায় সরকারি জমির পরিমাণ নগণ্য। তৃণমূল সরকারের আবার ঘোষিত জমি-নীতিই হল, শিল্পের জন্য জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না।
তা হলে জমি মিলবে কী করে? এই প্রশ্নের সদুত্তর নেই জেলা প্রশাসনের কাছেও। জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “যা হবে, সরকারি নির্দেশ মেনে হবে।” যদিও প্রশাসনেরই এক কর্তার দাবি, “ওই এলাকায় সরকারের কোন জমি নেই বললেই চলে। যাও বা ছিল, তা গত কয়েক বছরে ভূমিহারাদের পাট্টা হিসেবে বিলি করা হয়েছে। তাই ওই কয়লা প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে গেলে জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কোনও রাস্তা নেই।” ঘটনা হল, ওই অঞ্চলে অধিকাংশ জমির মালিকানা থাকা আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, প্রশাসনকে আগে এলাকায় এসে জমি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।
পাঁচামি এলাকার বাসিন্দাদের এই মনোভাবেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে জেলা পুলিশ-প্রশাসন। প্রশাসনের কর্তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাম আমলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে খাদান ও ক্রাশার মালিকদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরোধের জেরে কীভাবে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল আদিবাসী অধুষ্যিত এই এলাকা। বীরভূম জেলা আদিবাসী গাঁওতার সেই আন্দোলনের জেরে টানা দু’বছর ধরে ওই বিস্তীর্ণ এলাকা কার্যত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সেই ইতিহাসকে মাথায় রেখেই জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক কর্তা বলছেন, “এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই। কয়লা খনি শুরু করতে গেলে সবার আগে প্রশাসনিক ভাবে এলাকার জমিদাতাদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে। সেই আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা কিন্তু, হিতে বিপরীত হতে পারে!”
প্রশাসনের সূত্রের খবর, প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদে ভরা মহম্মদবাজারের ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় উচ্চমানের খড়িমাটি, পাথর, কয়লা তো আছেই, এমনকী প্রাকৃতিক গ্যাসের খোঁজেও দীর্ঘ দিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে ওএনজিসি-ও। তবে, এত দিন ওই সব অঞ্চল থেকে শুধু খড়িমাটি ও পাথর তোলা হতো। এ বার সরকারি উদ্যোগে সেখান থেকে কয়লা তোলার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই এলাকায় মজুত ২২০ কোটি টনের মধ্যে ১ কোটি টন কয়লা পাবে পশ্চিমবঙ্গ। তা ছাড়াও বিহার, কর্নাটক, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ এবং শতদ্রু জল বিদ্যুৎ নিগম কয়লার ভাগ পাবে। কেন্দ্রীয় সরকার খনিটি রাজ্যকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় প্রস্তাবিত সাগরদিঘি ও কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে কয়লার কোনও অভাব হবে না বলে জানিয়েছেন রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এই প্রকল্পে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কর্মসংস্থান হবে কয়েক হাজার মানুষের। প্রকল্পটি হলে বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশের আর্থ-সামাজিক চেহারাই বদলে যাবে।
নতুন কয়লা প্রকল্পকে ‘স্বাগত’ জানিয়েছেন এলাকাবাসী। কিন্তু, তার জন্য সরকারের কাছে বেশ কিছু শর্তও তাঁরা রেখেছেন। কারণ আগের বার নিগমকে জমি লিজ দেওয়া মথুরাপাহাড়ির কালীচরণ টুডু, চাঁদার মাধব মাড্ডি, সাগরবাঁধির খোকন মাড্ডি, বারোমেশিয়ার অনিল হাঁসদা, যোসেফ মুর্মুদের অভিজ্ঞতা, “জমি লিজ নেওয়ার সময় সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বছরে সামান্য কয়েক হাজার টাকা আমাদের ঘরে আসে। ওই দিয়ে কী পেট চলে!” তাই ঠেকে শিখেছেন মাধবরা। এ বার আর সহজে সরকারকে নিজেদের জমি ছেড়ে দেবেন না বলেই তাঁরা মনস্থির করেছেন। স্থানীয় জেঠিয়ার রাজীব হাঁসদা, শালডাঙার পারখ মুর্মু, হরিণসিঙার শ্যামল মুর্মুরা বলছেন, “আমরা উন্নয়ন চাই। কিন্তু, তা যেন আমাদেরই সর্বশান্ত না করে। সরকারের প্রয়োজনে সকলেরই জমি দেওয়া উচিত। তবে, সরকারকেও জমিদাতাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।” নিগম আজও প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ দেয়নি বলে তাঁদের অভিযোগ।
এ রাজ্যে পাঁচামির পরিচিতি পাথর শিল্পাঞ্চলের জন্য। কয়েকশো পাথর খাদান ও ক্রাশার আছে এখানে। পাঁচামি মাইনস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজির হোসেন মল্লিক বলেন, “শিল্প এখানে হোক, সেটা আমরাও চাই। তবে, তা করতে গিয়ে এখানকার পাথর শিল্পের যে কোনও ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে রাজ্য সরকারকে। কারণ, এই শিল্পের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে।”
কয়লা খনির জন্য জমি নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনকেই এগিয়ে সরাসরি জমি মালিকদের সঙ্গে কথা বলা উচিত বলে মত বারোমেশিয়ার পঞ্চায়েত সদস্যা মানি হাঁসদার। তিনি বলেন, “অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাঝখানে প্রচুর লোক ঢুকে পড়ে। শেষমেশ জমিদাতারাই বঞ্চিত হন। তাই জমি নেওয়ার আগে সরকারকেই সরাসরি জমি মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।” প্রকল্পে শুরুর আগে সরকারকে আগে দেখতে হবে এলাকার মানুষ ঠিক কী চান, এমনই দাবি বীরভূম জেলা আদিবাসী গাঁওতা সংগঠনের। গাঁওতার দুই নেতা সুনীল সোরেন রবিন সোরেন বলেন, “আমরা শিল্পের পক্ষে। আমরা চাই এলাকায় শিল্প হোক, কয়লা খনি হোক। কিন্তু, তার আগে প্রশাসনের কর্তাদের এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁদের জানতে হবে, সেখানকার বাসিন্দারা ঠিক কী চান।” সে ক্ষেত্রে জমিহারাদের পুনর্বাসন, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও কর্মসংস্থানের প্যাকেজ দাবি করছে গাঁওতা।
আর পাথরডাঙার বদন কিস্কু, বারোমেশিয়ার পূর্ণ টুডু, গাবারবাথানের সোনামুনি মুর্মুদের চাহিদা, “যেখানে আমাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে, সেই এলাকা যেন দূষণমুক্ত হয়। পানীয় জল, রাস্তাঘাট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy