Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

পিজি ছাড়তে বহু বাহানা, জেলেও মদন হাসপাতালে

জেলে, তবে সেলে নয়! গুরুতর কোনও অসুস্থতা নেই বলেই শনিবার সন্ধেয় এসএসকেএম হাসপাতাল ছুটি দিয়েছিল তাঁকে। জেলে ফেরা নিয়ে এর পর পাক্কা পনেরো ঘণ্টার নাটক। শেষমেশ রবিবার সকালে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলেও বন্দিদের কুঠুরিতে নয়, সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র রয়ে গেলেন হাসপাতালের কেবিনেই।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জেলের পথে মদন মিত্র। রবিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জেলের পথে মদন মিত্র। রবিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

দেবাশিস দাস ও অত্রি মিত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০০
Share: Save:

জেলে, তবে সেলে নয়! গুরুতর কোনও অসুস্থতা নেই বলেই শনিবার সন্ধেয় এসএসকেএম হাসপাতাল ছুটি দিয়েছিল তাঁকে। জেলে ফেরা নিয়ে এর পর পাক্কা পনেরো ঘণ্টার নাটক। শেষমেশ রবিবার সকালে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলেও বন্দিদের কুঠুরিতে নয়, সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র রয়ে গেলেন হাসপাতালের কেবিনেই। পিজি-র উডবার্ন ইউনিটের বদলে আলিপুর জেলের মন্দির ওয়ার্ড। হাসপাতাল ও ওয়ার্ডের নামটুকুই যা বদলাল। আদালতের নির্দেশে জেল হেফাজতে থাকা বন্দি মদনের আরাম-আয়েসের আয়োজন প্রায় একই রকম থেকে গেল রবিবারও। সোমবার থেকে যার আরও কিছুটা উন্নতি ঘটতে চলেছে। কারা প্রশাসনের যুক্তি, বন্দি হলেও মদন এখনও মন্ত্রীই।

এসএসকেএম ছুটি দেওয়ার পরে কলকাতা পুলিশের এক কর্তা শনিবার জানিয়েছিলেন, ওই রাতে পরিবহণ মন্ত্রীকে জেলে ফেরানো হচ্ছে না। কিন্তু জল্পনা ছিল, সাংবাদিকদের এড়িয়ে গভীর রাতেই হয়তো পিজি থেকে নিয়ে যাওয়া হতে পারে মন্ত্রীকে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় তাই পিজি-র চত্বর জুড়ে ছিল সংবাদশিকারি ও পুলিশের ভিড়। সেই ভিড়ে মাঝেমধ্যেই নানা রকম গুজব ছড়িয়েছেন হাজির কিছু মদন-ঘনিষ্ঠ। রটে মদন-অন্তর্ধানের একাধিক গল্পও।

শেষ পর্যন্ত পিজি থেকে মদনের বিদায়পর্ব ঘিরে নাটক মিটল রবিবার সকাল সাতটায়। উডবার্ন ওয়ার্ডের মেন গেট দিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন পরিবহণ মন্ত্রী। গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবির উপরে জড়ানো ঘিয়ে রংয়ের কাশ্মীরি শাল, পায়ে চামড়ার সাদা চটি, চুল এলোমেলো, খোঁচা খোঁচা দাড়ির সঙ্গে বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া মুখ। রাতভর অনিদ্রার চিহ্ন চোখেমুখে। তাঁকে ঘিরে জনা ছয়েক পুলিশ। গত ক’দিন দেখা গিয়েছে, বন্দি মদন সংবাদমাধ্যমের লোকজন দেখলে নিজেকে সংযত রাখতে পারছেন না। কিন্তু এ দিন মন্ত্রীর মেজাজ ছিল একেবারে অন্য। সংবাদমাধ্যমের দিকে ফিরেও তাকালেন না। গেট থেকে বেরিয়ে সটান উঠে গেলেন পুলিশের সাদা বোলেরো গাড়িতে। গাড়ি ছুটল আলিপুর জেলের উদ্দেশে। কার্যত হাঁফ ছাড়লেন পিজি-র কর্মীরা।

জেলে তখন পর্দা উঠছে নাটকের পরবর্তী পর্বের। ন’দিন পিজি-বাসের পরে মন্ত্রী ফিরেছেন। সসম্মানে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জেল-সুপারের ঘরে। দেওয়া হয় চা-বিস্কুট। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেখান থেকে তাঁকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতাল ওয়ার্ডে। জেলের চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করেন। আপাতত তাঁর ঠিকানা জেল হাসপাতালের চার নম্বর ওয়ার্ডের পাঁচ নম্বর বেড। ঘটনাচক্রে কঙ্কাল কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়ার পরে অসুস্থ সিপিএম নেতা তথা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জমানার মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ এই শয্যাতেই কাটিয়ে গিয়েছেন কিছু দিন।

এই সংযোগের কারণটা কী?

এর ব্যাখ্যা দিলেন কারা দফতরের এক কর্তা, “হাসপাতালে ওই একটি শয্যাই আছে, যেখানে খানিকটা হলেও কেবিনের সুবিধে দেওয়া যায়। সে কারণে ‘হাই প্রোফাইল’ অসুস্থ বন্দিদের অনেক সময়েই ওখানে রাখা হয়। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।”

ঠিকানা এক হলেও সুবিধের দিক থেকে সুশান্তর চেয়ে ঢের এগিয়ে থাকছেন মদন। সুশান্ত যখন গ্রেফতার হন তখন বামফ্রন্টের রাজ্যপাট আর নেই। অন্য দিকে, জেল হেফাজতে থাকলেও প্রশাসনের খাতায় মদন এখনও পুরোদস্তুর মন্ত্রী। তাই শুধু মন্দির ওয়ার্ডে ভাল থাকাই নয়, জেলে তাঁকে মন্ত্রীর সম্মানেই রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন কারা-কর্মীরা।

জেলে কেমন খাতিরযত্নের ব্যবস্থা থাকছে মন্ত্রীর জন্য?

কারা-কর্তারাই জানাচ্ছেন, মদনবাবুর ব্যাপারটা একটু ‘আলাদা’। রবিবার রাতটুকু হাসপাতালে কাটাতে হলেও সোমবার থেকে তাঁর ঠিকানা হবে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের ঠিক পাশে। খাতায়-কলমে ছ’নম্বর ওয়ার্ড হলেও যা আলিপুর জেলে ‘মন্দির ওয়ার্ড’ বলেই বেশি পরিচিত। ওয়ার্ডটি অনেক দিন ধরে ফাঁকা পড়ে ছিল। অব্যবহারে ধুলো জমেছিল। এক কারা-কর্তা বলেন, “সম্প্রতি সারদা কেলেঙ্কারিতে বেশ কয়েক জন ‘হাই প্রোফাইল’ বন্দি আসতে পারেন বুঝেই আমরা ওই ওয়ার্ডটি মেরামতের কাজ শুরু করেছিলাম। আপাতত ওখানে গোটাপাঁচেক শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সোমবার থেকে ওখানেই মন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে।”

রবিবার মন্ত্রী হাসপাতালে ঢোকার পরেই তাঁর পরিবারের তরফে বাড়ির খাবার দেওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। রাতের মধ্যেই তা মঞ্জুর করেছেন কারা দফতরের এডিজি অধীর শর্মা। তবে এ দিন বেশি কিছু খাননি মন্ত্রী। সকালে সুপারের ঘরে চা-বিস্কুট। আর সারা দিনে শুধু শুকনো মুড়ি। রাতে দু’টো রুটি আর পাঁচমিশেলি তরকারি। এক কারা-কর্তা বলেন, “জেলের খাবার বলে নয়, মন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁর অরুচি রয়েছে। বেশি খেতেই পারছেন না।” মন্দির ওয়ার্ডে মোটামুটি ভাল থাকার ব্যবস্থাই হয়েছে মন্ত্রীর জন্য। লোহার খাটে থাকছে নতুন তোষক, বালিশ ও কম্বল। আদালতের অনুমতি মেলায় পাবেন দু’জন বন্দি-সহকারীও।

তবে সুবিধে দেওয়ার থেকেও মন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন আলিপুর কারা-কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে, সারদা কেলেঙ্কারিতে আর এক অভিযুক্ত কুণাল ঘোষ সব নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যে ভাবে জেলে বসেই আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন কারা দফতর। দ্বিতীয় উদ্বেগের বিষয়, মন্ত্রীর স্লিপ-অ্যাপনিয়া রোগ। এক কারা-কর্তার কথায়, “মন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন, রাতে মাঝেমধ্যে তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে। এ রকম হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন। সে কারণেই তাঁর দিকে আমাদের বিশেষ নজর থাকবে।” আপাতত কারা দফতর ঠিক করেছে, হাসপাতালে না-রাখা হলেও ওয়ার্ডে মন্ত্রীর শরীরের উপরে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি রাখা হবে। যার দায়িত্বে থাকবেন মন্ত্রীর দুই বন্দি-সহকারীই।

এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে গেলেও পিজি-র মেডিক্যাল বোর্ড শনিবার বিকেলেই জানিয়ে দিয়েছিল, মন্ত্রীকে আর হাসপাতালে রাখার প্রয়োজন নেই। তার পর থেকেই তার জেলে ফেরা নিয়ে শুরু হয় নাটক। কখনও জানা গিয়েছে, মন্ত্রী জেলে যেতে রাজি, পুলিশের গাড়ি আসছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী আবার জানিয়ে দিচ্ছেন, হাসপাতাল কিছুতেই ছাড়বেন না। রাত যত বেড়েছে, এই টানাপড়েনও তত তীব্র হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে এসএসকেএমের মদন-ঘনিষ্ঠদের যাতায়াত। তবে অন্য সময়ের মতো মন্ত্রী-অনুগামীদের ভিড় নজরে পড়েনি সে ভাবে।

শনিবার বিকেল চারটেয় মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানার পরেই এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ তা জানিয়ে দিয়েছিলেন কারা দফতরকে। খবর পৌঁছয় আলিপুর জেলে। জেল কর্তৃপক্ষ জানার পরেই মন্ত্রীকে নিয়ে আসার তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। আলিপুর জেলের তরফে খবর দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশকে। এর পরেই উডবার্ন ওয়ার্ড ঘিরে ফেলে কলকাতা পুলিশের ভবানীপুর থানা ও রিজার্ভ ফোর্সের বাহিনী। ঠিক হয়, কড়া নিরাপত্তায় সন্ধে ছ’টা নাগাদ জেলে নিয়ে যাওয়া হবে মন্ত্রীকে। কিন্তু বেঁকে বসেন মন্ত্রী। জানিয়ে দেন, এখনই তিনি হাসপাতাল ছাড়তে রাজি নন।

মন্ত্রীর গোঁয়ে বিপাকে পড়ে যান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ-কর্তারা। দফায় দফায় পুলিশ-কর্তারা মন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হন। শেষে রাত ন’টা নাগাদ নবান্নের হস্তক্ষেপে জেলে যেতে রাজি হন মন্ত্রী। কিন্তু জানিয়ে দেন, শনিবার রাত তিনটের পরে কোনও একটি সময়ে তিনি জেলে যেতে রাজি। হাঁফ ছেড়ে তখনকার মতো ঘরে ফেরেন পুলিশ-কর্তারা। যদিও পুলিশের আনাগোনা এবং নজরদারি একটুও কমেনি। সেই নজরদারি ছিল অবশ্য শুধুই সংবাদমাধ্যমের জন্য। মন্ত্রীর জনাচারেক ঘনিষ্ঠ অনুগামীর যাতায়াত ছিল অবাধ।

এর মধ্যেই রাত দেড়টা নাগাদ হাসপাতাল চত্বরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, উডবার্ন ওয়ার্ডের পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে জেলের উদ্দেশে হাঁটা লাগিয়েছেন মন্ত্রী। কখনও আবার মন্ত্রীর অনুগামীরাই কানে কানে বলে যান, “দাদা এক চ্যালার স্কুটারে করে হাসপাতাল থেকে এয়ারপোর্টে চলে গিয়েছেন। সেখান থেকে নেপালে চলে যাবেন।”

ভোর পাঁচটা নাগাদ কুয়াশা মোড়া পিজি-র চত্বরে আসে পেল্লাই সাইজের পুলিশ-ভ্যান। উডবার্ন ওয়ার্ডের সামনে এসে দাঁড়ায়। নামেন জনা-বারো পুলিশকর্মী। তখনই কর্তব্যরত এক অফিসার জানিয়ে দেন, উডবার্নের তিন তলায় ২০ নম্বর কেবিনেই রয়েছেন মন্ত্রী। জেগে বসে আছেন। এর মধ্যেই মন্ত্রী জানিয়ে দেন, ভোর নয়, সকাল ন’টা নাগাদ তিনি হাসপাতাল থেকে জেলে যাবেন। ফের ফাঁপরে পড়েন পুলিশ-কর্তারা। এক অফিসারের কথায়, “কাল তো স্যরই বলেছিলেন সাতটায় বেরোবেন। এখন আবার কী হল কে জানে!” তরতর করে তিন তলায় উঠে মন্ত্রীর কেবিনে যান ওই অফিসার। পরে তিনি জানান, মন্ত্রী সাতটাতেই যেতে রাজি। তত ক্ষণে সাদা বোলেরো এসে দাঁড়িয়েছে উডবার্নের দোরগোড়ায়।

সাতটা নাগাদ নীচে নামেন মন্ত্রী। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রওনা দেয় গাড়ি। কিন্তু এসএসকেএমের পিছনের গেটে গিয়ে থমকে যায়। এ বার মন্ত্রীর বায়নাক্কায় নয়, ম্যারাথন প্রতিযোগিতার ভিড়েই আটকে যায় পুলিশের কনভয়। ম্যারাথনের ভিড় ঠেলে মন্ত্রীকে নিয়ে গাড়ি জেলে পৌঁছয় সাড়ে সাতটায়।

জেলের গেটে তখন হুড়োহুড়ি কারা-কর্মীদের। মন্ত্রী ফিরে এসেছেন। হোক না বন্দি হিসেবে!


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE