বিধানসভা ভোটের আগে তাদের স্লোগান ছিল ‘বদলা নয়, বদল চাই’। কথা রাখছে তৃণমূল! ক্ষমতায় আসার পরের তিন বছরে অবিরাম চলছে বদল! দল বদলের খেলায় বিরোধী শিবির ছেড়ে শাসক দলে নাম লেখাচ্ছেন নেতা-বিধায়কেরা।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে এখনও পর্যন্ত বর্তমান বিধানসভার ১৪ জন বিধায়ক যোগ দিয়েছেন শাসক দলে। বিধানসভার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে আরও ১৭ জন বিধায়ক দল ছেড়ে পিডিএফ নামে নতুন মোর্চা গড়েছিলেন। আরও পরবর্তী কালে অবশ্য সেই পিডিএফ থেকে পদত্যাগ করে ৩২ জন বেরিয়ে এসেছিলেন আইএনডিএফ নামে আরও একটি ফ্রন্ট গড়ার জন্য। ১৯৬৭’র সেই ঘটনা ছাড়া এ রাজ্যে একটি বিধানসভার আমলে এত জন বিধায়কের দল বদলানোর (পরিষদীয় পরিভাষায় যাকে বলে ‘ফ্লোর ক্রসিং’) আর কোনও নজির নেই। তবে সেখানেও প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৬৭-র সেই অস্থিরতা ছিল সরকার ফেলা বা গড়াকে কেন্দ্র করে। এখন তৃণমূল একক ভাবেই বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। সরকার ভাঙা-গড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। সরকার গড়া বা অনাস্থা সংক্রান্ত ভাঙন সরিয়ে রাখলে এ বারের বিধানসভা সেই অর্থে দল বদলের রেকর্ডে এক নম্বরে! বিরোধী শিবিরের এক নেতার আরও প্রশ্ন, “এই বিধানসভার আরও তো দু’বছর বাকি! পাঁচ বছর কাটলে তা হলে কী হবে!”
হিন্দি বলয় থেকে ‘দলবদলু’ কথাটা এখন দিব্যি ছড়িয়ে গিয়েছে এ রাজ্যের বিধানসভার অলিন্দে! কেন এত ‘দলবদলু’র রমরমা? বিরোধী শিবির আঙুল তুলছে শাসকের দিকে। অভিযোগ করছে, ভয় বা প্রলোভন দেখিয়ে দল ভাঙানো হচ্ছে। শাসক দল আবার পাল্টা বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডই আসল ম্যাজিক! আর বিরোধী দলের নেতৃত্ব নিজেদের দল ধরে রাখতে ব্যর্থ বলেও পাল্টা দাবি সরকারি দলের নেতাদের।
কিন্তু এই তরজার মধ্যেই সব দলের নেতারা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, আদর্শ-ভিত্তিক রাজনীতির আর ছিঁটেফোটাও অবশিষ্ট নেই! নইলে এ জিনিস হয় না। বিধানসভার ইতিহাস-চর্চায় আগ্রহী দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “যাঁরা দল ছেড়ে যাচ্ছেন এবং যাঁরা দলে নিচ্ছেন, দু’দিকেই মূল্যবোধের অভাব হয়েছে। আগে বহু দুঃস্থ বিধায়ক এই বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ কোনও পরিস্থিতিতেই দল বদলাননি!”
বিধানসভার রেকর্ড বলছে, ১৯৫২ সালে গঠিত প্রথম বিধানসভায় শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নেপাল রায়, পঞ্চানন লেট ও কৃপাসিন্ধু সাহু ফরওয়ার্ড ব্লকের এই চার জনের কংগ্রেসে যোগদানই এ রাজ্যে বিধায়কদের দলবদলের প্রথম নজির। ১৯৭১-৭২ সালে ফব ছেড়ে কংগ্রেসে গিয়ে স্পিকার হয়েছিলেন অপূর্বলাল মজুমদার। তত্কালীন প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টি ছেড়েছিলেন চার জন। আবার ১৯৮২ সালে জনতা দল থেকে বেরিয়ে ৭ বিধায়ক গিয়েছিলেন ডিএসপি এবং এসপি-তে। সে সবই কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের জন্য দলত্যাগ-বিরোধী আইন চালু হওয়ার আগের ঘটনা। দলত্যাগ ঠেকানোর আইন কার্যকর থাকা সত্ত্বেও তার আওতা থেকে বাঁচতে দফায় দফায় বিধায়ক ভাঙানোয় নজির গড়ে ফেলেছে এই পঞ্চদশ বিধানসভার তিন বছর!
সমাজবাদী পার্টির চাঁদ মহম্মদকে দিয়ে এখনকার বাম পরিষদীয় দলে ভাঙনের শুরু। একে একে ফব-র সুনীল মণ্ডল, আরএসপি-র দশরথ তিরকি, অনন্ত দেব অধিকারী হয়ে সদ্য সিপিএমের ছায়া দলুই। তৃণমূলে যোগ দিয়ে দেওয়ার পরে ছায়াকে (সেই সঙ্গেই ক্ষীরপাই পুরসভার চেয়ারম্যান দুর্গাশঙ্কর পান) সিপিএম শেষ পর্যন্ত বহিষ্কার করলেও তাদের অভিযোগ, চন্দ্রকোনার বিধায়ককে ভয় দেখিয়ে, চাপ দিয়ে দল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর বক্তব্য, ঘোড়া কেনাবেচা করলেও এ ভাবে মানুষ কেনা যায় না! সিপিএম বিধায়কের তৃণমূলে যোগ দেওয়া ‘অভাবনীয় ঘটনা’ বলেই মেনে নিচ্ছেন মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর যুক্তি, এক ধরনের লোক সব সময়ই শাসক দলের দিকে থাকতে চায়। সেই সঙ্গেই শোভনদেবের আরও বক্তব্য, “এখন শাসক দলের কিছু অংশের কাজে কিছু মানুষ সমালোচনা করলেও মমতা উন্নয়নের কাজটা আন্তরিক ভাবে করে যাচ্ছেন। আর বিরোধী দল লড়াই-আন্দোলনে যেতে ব্যর্থ। তাই তৃণমূলের দিকে লোক চলে আসছে।”
কংগ্রেসের ভাঙন শুরু হয়েছিল কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী ও হুমায়ুন কবীরকে দিয়ে। তার পরে সৌমিত্র খাঁ, অজয় দে, সুশীল রায়, ইমানি বিশ্বাস, অসিত মাল, গোলাম রব্বানি, উমাপদ বাউড়ি একে একে ৯ জন এ পর্যন্ত তৃণমূলে পা বাড়িয়েছেন। তালিকা এখানেই শেষ হবে, হলফ করে বলার কেউ নেই! কংগ্রেসের বর্ষীয়ান বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার মতে, “২০০১-এ আমরা তৃণমূলের বি টিম, ২০০৪-এ সিপিএমের বি টিম, ২০০৬-এ একা, ২০০৯ সাল এবং ২০১১’য় আবার তৃণমূলের বি টিম! এই করতে করতে নিজেরা ‘এ টিম’ হতে পারলাম না! দলের রাজনৈতিক দিশা স্পষ্ট না হলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকবেই।”
দলবদলের এই বাজারে সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হয়েও অন্য দলে যাননি আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। তাঁর বক্তব্য, পরের বার বিধানসভায় নিজেদের দলে থেকে আর জিততে পারবেন না ভেবে অনেক বিধায়ক তৃণমূলে যাচ্ছেন। বিধানসভার বাইরে আবার বিজেপি-র দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। রেজ্জাকের কথায়, “আদর্শের রাজনীতি তো আর নেই। মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে বলছেন, আদর্শ থাকলে আমাদের দলে আসুন! বাংলা কেন, গোটা ভূ-ভারতে কখনও এমন জিনিস হয়েছে বলে আমার জানা নেই!”
সিপিএম তো দীর্ঘ দিন শাসক দল ছিল। তখন এমন শাসক দলে নাম লেখানোর হিড়িক ছিল না কেন? আর পাঁচটা বিষয়ে সিপিএমের কট্টর সমালোচক রেজ্জাক বলছেন, “অনেকে হয়তো মনে মনে চাইলেও ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। সিপিএম আর যা-ই করুক, যাকে তাকে দলে নিত না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy