সময়টা টেনেটুনে দু’বছরও নয়। তার মধ্যে বংশবৃদ্ধি সাত গুণ!
সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের অধীনস্থ রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ (আরওসি)-এর নথি ঘেঁটে এমনই তথ্য পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, ২০১০-এর শেষ থেকে ২০১২-র মাঝামাঝি এই কুড়ি-একুশ মাসে সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠী বহরের নিরিখে সবচেয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। একটি অর্থলগ্নি সংস্থার এ হেন বিস্ময়কর বাড়বাড়ন্ত তখন কেন্দ্রীয় নিয়ামকদের নজর এড়িয়ে গেল কেন, সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।
নথি অনুযায়ী, ২০১০-এর নভেম্বর পর্যন্ত সারদা গোষ্ঠীর অধীনে ২০টি সংস্থা ছিল। ২০১২-য় গিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৬০! মানে, বৃদ্ধির হার নয়-নয় করে ৭০০%! যার মধ্যে ২০১১-তেই ১০৪টি নতুন সংস্থা খোলা হয়। সারদার কোম্পানি-তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ভিবজিওর মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড। ২০১২-র ১১ জুলাই সুদীপ্ত সেন সেটি কেনেন।
সম্প্রতি কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের অধীনস্থ তদন্তকারী সংস্থা সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১২-র মধ্যে সারদা প্রায় ২০৩০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছিল। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক শাসনক্ষমতায় পালাবদলের পরেই যে সারদার আমানত-অভিযানে জোয়ার লাগে, এসএফআইও-রিপোর্টে সে ইঙ্গিত স্পষ্ট। তাদের হিসেব বলছে, ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে সারদা বাজার থেকে তুলেছিল যথাক্রমে ৮০০ কোটি ও ৭৩৪ কোটি টাকা। যেখানে আগের তিন বছরে সারদার মোট আমানত সংগ্রহের অঙ্ক সাড়ে পাঁচশো কোটি ছাড়ায়নি।
এখন আরওসি-র কাগজপত্রে সারদার সংস্থাবিস্তারের বৃত্তান্ত দেখে-শুনে তদন্তকারীদের অনুমান, বেশি বেশি আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যেই সুদীপ্ত সেন ২০১১-র গোড়া থেকে একের পর এক কোম্পানি, কিংবা নতুন কোম্পানি ফেঁদে বসছিলেন। এবং তদন্তকারীদের সন্দেহ, তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় আসছে আঁচ করেই তাঁর এই পদক্ষেপ। এক অফিসারের মন্তব্য, “২০১১-র জানুয়ারিতে সারদা ৯৩টি কোম্পানি খোলে। ফেব্রুয়ারিতে আরও ১১টি। তৃণমূলের পালে বাতাসের বেগ যত বেড়েছে, তত দীর্ঘ হয়েছে সারদার সংস্থা-তালিকা।”
সারদার রমরমার পিছনে তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা ছিল বলে বিরোধীদের মুখে বারবার অভিযোগ শোনা গিয়েছে। যার প্রতিক্রিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার জানিয়েছেন, সারদার জন্ম বাম আমলে। এই যুক্তিতে কেলেঙ্কারির দায় পূর্বতন বাম সরকারের ঘাড়েই চাপাতে চেয়েছেন তিনি। অন্য দিকে তদন্তকারীদের বক্তব্য: সারদার জন্ম যে বাম আমলে, তাতে সন্দেহ নেই। ১৯৯৫-এ সারদা কনস্ট্রাকশন দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু। তবে বাড়বাড়ন্ত মূলত এমন সময়ে, ঘটনাচক্রে যখন জমানা পাল্টে যাচ্ছে বা গিয়েছে। “এসএফআইও-র রিপোর্টে এর প্রমাণ রয়েছে। আরওসি-র তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে।” পর্যবেক্ষণ এক তদন্তকারীর।
এবং এরই প্রেক্ষাপটে ‘প্রভাবশালী’ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও আমলাদের একাংশের সঙ্গে সারদা-কেলেঙ্কারির যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে সিবিআই। তদন্তকারীদের মতে, এক সঙ্গে এত কোম্পানির মালিকানা নথিভুক্তি করাটা আইনের চোখে অবৈধ না-হলেও অতি বিরল। নামজাদা বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এমন নজির নেই, যা সারদা দেখিয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠছে, ঘটনাটির মধ্যে অস্বাভাবিকতা রয়েছে কিনা, কেন্দ্রীয় নজরদারি এজেন্সিগুলো গোড়া থেকে তা যাচাই করার তাগিদ কেন বোধ করল না? সারদা-কাণ্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁদের অন্যতম অমিতাভ মজুমদারের কথায়, “সারদা এত দ্রুত এতগুলো কোম্পানি খুলল! অথচ সব ব্যালান্স শিট জমা দিল না! আর এ সব তথ্য থাকতেও এত দিন কোনও কেন্দ্রীয় এজেন্সি তদন্ত করল না! আশ্চর্য!”
অমিতাভবাবুর দাবি, পুরোটাই ষড়যন্ত্র। এ জন্য খোদ আরওসি এবং অন্যান্য ‘প্রভাবশালী’ মহলের দিকে তিনি আঙুল তুলেছেন। প্রসঙ্গত, সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টও আরওসি-সহ আর্থিক ক্ষেত্রের বিবিধ নিয়ামক সংস্থার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে বলেছে।
সিবিআই-সূত্রের খবর: তৃণমূলের একাংশের সঙ্গে সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের ঘনিষ্ঠতার সূচনা ২০০৯-এর পরে, যখন কিনা রাজ্যের রাজনৈতিক আকাশে পরিবর্তনের মেঘ ঘনাচ্ছে। সারদা-সাম্রাজ্যের পত্তন যেখানে, দক্ষিণ ২৪ পরগণার সেই বিষ্ণুপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের হাত ধরেই যোগাযোগ সূত্রপাত। ক্রমশ তা তৃণমূলের শীর্ষস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রী হন। মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই রেলের কেটারিং ও পর্যটন নিগমের (আইআরসিটিসি) সঙ্গে সারদার চুক্তি হয়েছিল। তদন্তকারীদের সন্দেহ, ওই সময়ে কেন্দ্রীয় আমলাদের একাংশের সঙ্গেও সারদার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। সংস্থাবিস্তারের কাজে যাদের প্রভাব পুরোদস্তুর কাজে লাগান সুদীপ্ত সেন।
তদন্তকারীদের কেউ কেউ বলছেন, ব্যবসা বাড়াতে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার কিংবা কলকাতার বর্তমান পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থের মতো লোকজনের ভাবমূর্তি যে সারদা ব্যবহার করেছিল, এসএফআইও-রিপোর্টেও তা বলা হয়েছে। কিন্তু সেবি, আরওসি বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো নজরদারদের ‘গাফিলতির’ উল্লেখ কোথাও সে ভাবে করা হয়নি। এখন পর্যন্ত সিবিআই-তদন্তেও ওই সব নিয়ামক সংস্থাকে নিয়ে টানাটানি পড়েনি।
সেটা হলে অজানা বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy