গুয়াহাটির আদালতে শনিবার মহিলা জঙ্গি সুজানা বেগম। কোলে দেড় বছরের ছেলে। ছবি: উজ্জ্বল দেব
স্বামীর মাথার দাম এনআইএ ঘোষণা করেছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। স্ত্রী ধরা পড়ার পর গোয়েন্দাদের মনে হচ্ছে, তারও মাথার দাম ধরা হলে স্বামীকে সে অনায়াসে পেছনে ফেলত। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা থেকে অসম পুলিশের বড়কর্তারা মোটামুটি নিশ্চিত, গত কাল গুয়াহাটিতে গ্রেফতার হওয়া সুজানা বেগম নিছকই বরপেটার চতলা গ্রামের ফেরার হাতুড়ে শাহনুর আলমের স্ত্রী নয়। বরং জেহাদি সংগঠনে হয়তো শাহনুরের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সে। এমনকী শাহনুরকে সে-ই জেহাদের পথে টেনে এনেছিল, এই সন্দেহও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে এই সুজানাকেও প্রাথমিক ভাবে সন্দেহের তালিকায় রাখেননি গোয়েন্দারা! বরং বর্ধমানের মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসায় অনুদান পাঠানোর সূত্রে শাহনুরকেই খুঁজছিল এনআইএ। সম্প্রতি পুলিশ খবর পায়, দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে বেঙ্গালুরু পালাচ্ছে সুজানা। তার পরেই জাল বিছিয়ে গত কাল গুয়াহাটির বাস টার্মিনাস থেকে পাকড়াও করা হয় তাকে। গ্রেফতারের পর সুজানাকে টানা জেরা করতে গিয়েই অবাক হয়ে যান পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর অফিসারেরা। তখনই তাঁরা জানেন, সুজানা শুধুই জেহাদে স্বামীর ছায়াসঙ্গী ছিল না। তার থেকে বেশিই ছিল।
কী রকম?
পুলিশ সূত্রের খবর, সুজানা ওরফে সুরজিয়া নিজে কলেজ-শিক্ষিত। শাহনুর গিয়েছিল শিমুলিয়া মাদ্রাসায় পড়তে। সুজানা তখন ওই মাদ্রাসাতেই জেহাদি প্রশিক্ষণ দিত। সেখানেই শাহনুরের সঙ্গে তার আলাপ। এবং তাই পুলিশের ধারণা, হয়তো সুজানাই শাহনুরকে জেহাদের পথে টেনে এনেছিল।
জেরা করতে গিয়ে সুজানার আরও বেশ কয়েকটি ‘গুণ’-এর কথা জানা গিয়েছে। জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া বিভিন্ন মাদ্রাসায় হাওয়ালা মারফত টাকা পাঠাত শাহনুর। সুজানাই সেই হাওয়ালার খুঁটিনাটি তদারক করত। ইন্টারনেটে জেহাদের স্থানীয় নেটওয়ার্ক বাড়িতে বসেই নিয়ন্ত্রণ করত সে। মাঝে মাঝে সুজানা নিজেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ঘাঁটিতে যেত। শিমুলিয়া মাদ্রাসা-সহ একাধিক জেহাদি ঘাঁটিতে তার নামেই নিয়মিত লক্ষাধিক টাকার অনুদান পাঠানো হত। সুজানাকে জেরা করে বেশ কিছু ই-মেল আইডির সন্ধান পেয়েছে পুলিশ ও এনআইএ। সেই সমস্ত আইডি খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বরপেটায় কোন পথে টাকা আসত, তার খোঁজও চলছে। আজ তাকে গুয়াহাটির মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তোলা হলে তার ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজত হয়।
সুজানার সঙ্গে অসমের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে বলেও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের একাংশের দাবি, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অসম শাখাই শাহনুর ও সুজানাকে পালাতে সাহায্য করছিল। এই সংগঠনটির নাম এর আগেই বিভিন্ন সূত্রে গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। পুলিশের সন্দেহ, সুজানা যেমন বেঙ্গালুরু পালাচ্ছিল, তেমন শাহনুরকেও হয়তো দক্ষিণ ভারতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বা এখনও তাকে দক্ষিণ ভারতে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। পুলিশ অবশ্য এখনই ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে হানা দিচ্ছে না।
বরং নিরীহ গৃহবধূর ছদ্মবেশে এই ধরনের জেহাদি নারীবাহিনী গড়ে ওঠা দেখেই গোয়েন্দারা কিছুটা অবাক। তাঁরা বলছেন, এত দিন ধরে বিভিন্ন জঙ্গি মডিউলে পুরুষদেরই দেখা গিয়েছে। কিন্তু এই সংগঠনগুলি যে নারীবাহিনীও তৈরি করেছে, সে ব্যাপারে চোখ খুলে দিল খাগড়াগড়।
বিস্ফোরণের পরেই খাগড়াগড়ের বাড়িতে পুলিশকে আটকাতে রিভলভার উঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল আলিমা ও রাজিয়া বিবি। গ্রেফতারের পরে জেরার সময়ে নানা ভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করত তারা। একই ভাবে গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল নদিয়ার খানসা বিবি। সুজানার মতো খানসার স্বামী জহিরুল শেখকে খুঁজছে পুলিশ। নদিয়ার থানারপাড়ায় জহিরুলের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৪১টি জিলেটিন স্টিক ও প্রচুর জেহাদি কাগজপত্রের পাশাপাশি একটি ডায়েরিও মেলে। তাতে লেখা ‘রক্ত’, ‘জেহাদ’, ‘হাতে তুলে নাও তরোয়াল, একে ৪৭’-এর মতো কথাকে গজল বলে চালানোর চেষ্টা করেছিল খানসা। সে-ও প্রমীলা জঙ্গি বাহিনীর সদস্য বলে গোয়েন্দাদের দাবি। খানসাকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বর্ধমানের জঙ্গি মডিউলের শীর্ষ চরিত্র সাজিদের স্ত্রী ফতেমাও এই প্রমীলা বাহিনীর সদস্য। তারও সন্ধান চলছে।
গোয়েন্দাদের সন্দেহ, এ রাজ্যের বহু জেলাতেই এমন সুজানা-খানসা লুকিয়ে রয়েছে। আপাত ভাবে যাদের দেখে জঙ্গি বলে মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসলে এরা শুধু জেহাদি মগজধোলাই নয়, অস্ত্র চালাতেও পুরুষদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারে। আর ধরা পড়ে গেলে পুলিশ-গোয়েন্দাদের কথার জালে বিভ্রান্ত করতেও তারা রীতিমতো দড়।
আলিমা, রাজিয়া, খানসা, সুজানা... উদাহরণ তো চোখের সামনেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy