অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তাঁর দলনেত্রী প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন! “কুণাল চোর, টুম্পাই চোর, মদন চোর, মুকুল চোর? আমি চোর?”
তাঁর দলনেত্রীর নির্দেশে মিছিল বেরিয়েছিল, হাতে প্ল্যাকার্ড “আমরা সবাই চোর!”
দলনেত্রীর ‘অনুগত’ মন্ত্রী কিন্তু ‘চোর’ শব্দটা একেবারেই পছন্দ করলেন না! জেলের মধ্যে নেহাতই নগণ্য এক বন্দির মুখ থেকে তকমাটা যখন তাঁর দিকে ধেয়ে এল, মদন মিত্র চটে কাঁই!
কারা-কর্তারা প্রকাশ্যে কেউ কিচ্ছুটি বলছেন না বটে! কিন্তু সূত্রের খবর, ঘটেছে এমনটাই।
রবিবারের আলিপুর জেল। সন্ধে নামছে তখন। হিমেল হাওয়ায় জমাটি শীতের আমেজ। শেষ বেলার মাথা-গুনতি করে লক-আপ শুরু হয়েছে বন্দিদের। মন্ত্রীমশাইও জেল চত্বরে এ-দিক ও-দিক ঘোরাফেরা সেরে নিজের আস্তানা, মন্দির ওয়ার্ডের পথে। ঠিক সেই সময়েই মন্ত্রীর সামনে পড়ে গেল পাশের ওয়ার্ডের কার্তিক অধিকারী! পুলিশ মহলে পরিচিত মুখ। ছিঁচকে নেশাখোর বলে বিশেষ খ্যাতিও আছে। কথা নেই, বার্তা নেই এ হেন কার্তিক দুম করে বলে বসল, “আমরা তো চোরই। এখন দেখছি মন্ত্রীও চুরি করে ভিতরে!”
বেশ একটু জোরেই বলে ফেলেছিল কথাটা। নিজের ওয়ার্ডে ঢোকার পথে কার্তিকের বাণী পরিষ্কার শুনতে পেলেন মন্ত্রীমশাই। কড়া চোখে ছেলেটিকে জরিপ করে নিলেন তিনি। বেগতিক বুঝে কার্তিকও কথা না বাড়িয়ে নিজের কুঠুরির দিকে চম্পট দিল।
হলো কী কার্তিকের? মাদকাসক্ত বলে তাকে জানে সবাই। নেশার টানেই হাতটান। বহু বার জেলে এসেছে, গিয়েছে। জেলে বসে আইনত নেশা করার উপায় নেই। তবে চোরাগোপ্তা কত কিছুই তো মেলে! কার্তিকের সঙ্গীরা ভাবতে বসে, শীতের সন্ধেয় নেশার দম কি একটু বেশিই চড়ে গিয়েছিল?
কে জানে কী ভর করেছিল কার্তিকের উপরে! কিন্তু ক্রীড়া ও পরিবহণ মন্ত্রীর রাগ তাতে পড়বে কেন?
আলিপুর জেল সূত্রের খবর, ওয়ার্ডে ঢুকেই মদন ডেকে পাঠালেন জেলের কয়েক জন অফিসার-কারারক্ষীকে। তাঁরা প্রত্যেকেই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। মদন বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই তাঁদের কাছে ঘটনাটি জানালেন। জেলের বাইরে থাকতে না-হয় বিরোধীদের কাছে শুনতে হয়েছে এই রকম সব কটাক্ষ! সে তো প্রয়াত এক প্রধানমন্ত্রীকেও শুনতে হয়েছিল, গলি গলি মে শোর হ্যায়..। রাজনীতির ময়দানে এ সব গায়ে মাখলে চলে না! কিন্তু তাই বলে এক নেশাড়ু ছিঁচকে চোর... সে-ও গালমন্দ করবে? চোরছ্যাঁচোড়ের সঙ্গে একাসনে বসাবে? মদনের গোঁসা ভাঙাতে তখন জেল-অফিসারদের কালঘাম ছুটছে। এক কর্মী জানাচ্ছেন, “কী করে যে মন্ত্রীকে ঠান্ডা করব, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। কোনও রকমে অনেক ক্ষণ ধরে এ-কথা, সে-কথা বলে তাঁকে শান্ত করা হলো। আর কার্তিককে সঙ্গে সঙ্গেই ‘পানিশমেন্ট’ সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।”
সে না-হয় হলো! কিন্তু এ বার তো কার্তিকের ক্রুদ্ধ হওয়ার পালা!
সোমবার সকাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে তার গজর-গজর! “চোরকে চোর বলতে পারব না? শাস্তি পেতে হবে?” পানিশমেন্ট সেল-এর ঘুপচি ঘরে থাকতে হবে! যখন-তখন আর গরাদের বাইরে বেরোতে দেওয়া হবে না! এ কেমন বিচার? মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনও প্রমাণ হয়নি, প্রমাণ হওয়ার আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না এ সব যুক্তি কে বোঝাবে কার্তিককে? তার একটাই কথা, “আমরাও চুরির দায়ে জেলে এসেছি। সবাই তো আমাদেরও চোর বলে! তার বেলা?”
এক দিকে মন্ত্রী ফুঁসছেন আর এক দিকে কার্তিক গজগজ করছে! মাঝখানে জেলকর্মীরা কাঁটা হয়ে আছেন। জেলের মধ্যে মন্ত্রীর মতো ‘ভিআইপি’ বন্দির নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে। রয়েছে সম্মানের বিষয়টিও। ঠিক হয়েছে, মদনের নিরাপত্তা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হবে। জেল সূত্রের খবর, এমনিতে মদন সে ভাবে ওয়ার্ডের বাইরে খুব একটা বের হন না। তাঁর ওয়ার্ডের অন্য বন্দি প্রদীপ, শুভেন্দুরা ভাল ভাবেই মন্ত্রীর দেখভাল করেন। মন্ত্রীকে সঙ্গে করে এখানে-ওখানে নিয়ে যান। ওয়ার্ড থেকে বেরোলেও শুভেন্দুদের সঙ্গেই একটু-আধটু ঘোরাফেরা করেন মদন। সাধারণত অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথা বলেন না। তবে কোনও বন্দি নিজে কথা বলতে এলে, কোনও প্রশ্ন করলে তিনি ভাল ভাবেই জবাব দেন।
সারদা কেলেঙ্কারিতে আরও কয়েক জন বন্দি রয়েছেন আলিপুর জেলে দেবব্রত (নিতু) সরকার, রজত মজুমদার, সন্ধির অগ্রবাল এবং সুদীপ্ত সেন। এ ছাড়াও রয়েছেন কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও। জেল সূত্রের খবর, রজত মজুমদারকে সে ভাবে পাত্তা দেন না মন্ত্রী। তবে অনেক দিনই ‘মন্দির’ ওয়ার্ডের বাইরে হত্যে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে নিতু আর শম্ভুনাথকে। মন্ত্রী একটু বেরোলে যদি কথা বলা যায়। জেলের এক অফিসার বলেন, “এমনিতে শম্ভুনাথের দিকে ফিরে তাকান না মন্ত্রী। তবে নিতুর সঙ্গে মাঝে-মধ্যে খোশগল্প করেন।”
জেলজীবনে এ যাবৎ দেড় মাস মদনকে এ ভাবেই দেখে এসেছেন সকলে। মোটামুটি নির্বিবাদেই কাটছিল সব। রবিবারই বেমক্কা তাল কাটলো। তবে বেফাঁস কোনও কথা উড়ে এলে মন্ত্রীর এমন মেজাজ নতুন নয় বলেই ঘনিষ্ঠদের মত। এ প্রসঙ্গে সিবিআইয়ের এক কর্তা জানান, জেরার সময় তাঁদের এক অফিসার ঝাঁঝিয়ে কথা বলতেই মদন কড়া ভাবে তাঁকে বলেছিলেন, “মনে রাখবেন, আমি এখনও মন্ত্রী। আপনি আমাকে স্যালুট করেন!”
সিবিআই কর্তারাই যখন ধমক খেয়ে গিয়েছেন, তুচ্ছ বন্দিরা কি আর পার পাবেন? কার্তিক-পর্বের পরে এখন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বন্দিদের উপরে একটু লাগাম টানার কথাই ভাবছেন কারা-কর্তারা। তাঁদের একটাই ভয় কে আবার কী বলে বসবে! তার হ্যাপা কে সামলাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy