Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

‘কঠিন সময়ে’ আতঙ্কে বাসিন্দারাও

ফাঁড়ি বা থানার ভিতরে নিরাপত্তা নেই। বাইরে অভিযানে গেলে যে আরও-ই নেই, তার প্রমাণ পেয়েছেন সদ্য নিহত এক এসআই-এর পরিবার। এ বার সামান্য বোমা উদ্ধার করতে গিয়েও সেই নিরাপত্তার অভাব ভালই টের পেলেন থানার অফিসার-ইন-চার্জও। ‘কঠিন সময়’ যেন কাটছে না বীরভূম পুলিশের!

সিউড়ি হাসপাতাল চত্বরে আক্রান্ত পুলিশের গাড়ি।  ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

সিউড়ি হাসপাতাল চত্বরে আক্রান্ত পুলিশের গাড়ি। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২০
Share: Save:

ফাঁড়ি বা থানার ভিতরে নিরাপত্তা নেই। বাইরে অভিযানে গেলে যে আরও-ই নেই, তার প্রমাণ পেয়েছেন সদ্য নিহত এক এসআই-এর পরিবার। এ বার সামান্য বোমা উদ্ধার করতে গিয়েও সেই নিরাপত্তার অভাব ভালই টের পেলেন থানার অফিসার-ইন-চার্জও।

‘কঠিন সময়’ যেন কাটছে না বীরভূম পুলিশের!

শুক্রবার পাড়ুই থানার মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের চৌমণ্ডলপুর গ্রামে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পরে জেলা পুলিশের এই কঙ্কালসার চেহারাটাই ফের বেরিয়ে পড়ল বলে মনে করছেন এই জেলার বহু মানুষ। পাশাপাশি তাঁরা আরও একটি দিকও খেয়াল করিয়ে দিত চাইছেন। কয়েক বছর আগেও জেলার নানুরের মতো গুটি কয়েক কিছু এলাকাতেই ভুরি ভুরি বোমা উদ্ধার হত। কিন্তু সাম্প্রতিক এমন কিছু উদাহরণ সাধারণ মানুষের সামনে উঠে এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে যেন বারুদের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বীরভূমের মানুষ! আজ, সদাইপুর, কাল ইলামবাজার তো পরশু কাঁকরতলা বোমা উদ্ধার থেমে নেই এই জেলায়। এবং এ ব্যাপারে কিন্তু পুলিশি দুর্বলতাকেই দুষছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা। জেলার এক প্রবীণ বাসিন্দার খেদ, “বাম আমলে যা দেখেছি, এখন তা আরও বেড়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মন রেখে চলতে চলতে পুলিশ যেন তার নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধেই সন্দিহান হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল হয়ে যাওয়া এমন দুর্বল পুলিশকে দেখে দুষ্কৃতীরা আর তাই ভয় পাচ্ছে না।” এই কারণেই জেলায় বারবার পুলিশ সহজেই আক্রমণের মুখে পড়ছে বলে তাঁর বিশ্লেষণ।

পাড়ুইয়ের চৌমণ্ডলপুরে ঘটনার পরে এসপির
নেতৃত্বে চলছে টহল। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

এ বারের ঘটনায় বেশি করে বিজেপি-র নাম উঠে এলেও অতীত কিন্তু অন্য কথাও বলছে। যে সূত্রে উঠে আসছে গত পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারের সময় পাড়ুইয়ের কসবা বাসস্ট্যান্ডে জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সেই বক্তৃতা। যেখানে তাঁকে প্রকাশ্যেই পুলিশ-প্রশাসনকে বোমা মারার নির্দেশ দিতে শোনা গিয়েছিল। বস্তুত, তার পরে জেলায় পুলিশের উপরে হামলার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেকটিতে অভিযুক্ত তৃণমূলেরই নেতা-কর্মীরা। গত জুনে দুবরাজপুরে তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছিল। বোমার আঘাতেই গুরুতর জখম তরুণ এসআই অমিত চক্রবর্তীর পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছিল। এসআই খুনের ঘটনায় অন্যতম দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তৃণমূলের শেখ আলিমকে পুলিশ আজও গ্রেফতার করতে পারেনি। তার পরের মাসেই আবার এক ব্লক তৃণমূলে নেতার নেতৃত্বে খয়রাশোলের লোকপুর ফাঁড়িতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছিল। আবার গত সেপ্টেম্বরে বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পিটিয়ে শিরোনামে এসেছেন শাসক দলেরই যুব নেতা সুদীপ্ত ঘোষ। আদালত দু’বার তাঁর আগাম জামিনের আর্জি খারিজ করেছে। পুলিশ কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি। দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের আমলে বীরভূমে পুলিশ শুধু ঘটনাস্থলে গিয়েই আক্রান্ত হচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে ফাঁড়ি বা থানার ভেতরেও তাঁরা নিরাপদ নন! এমনকী, সহকর্মী খুন হয়ে গেলেও পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারছে না!

এই সব ঘটনার জেরে জেলায় পুলিশের মনোবল অনেকটাই তলানিতে এসে ঠেকেছে বলে মনে করছে পুলিশেরই নিচুতলার কর্মীরা। যার নমুনা দেখা গিয়েছিল দু’দিন আগেই কাঁকরতলা থানা এলাকায় একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায়। রাতে খবর পেয়েও পুলিশ সে দিন আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার সাহস করেনি। পুলিশ কর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, তাঁরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। তাই এ দিন অল্প পুলিশ কর্মী থাকলেও বোমার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ দত্তেরা (পাড়ুই থানার ওসি)। সেখানে গিয়ে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়লেও তাঁরা যথাসাধ্য লড়ার চেষ্টাটুকু অন্তত করেছিলেন।

পাড়ুইয়ের সাত্তোর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুক্রবার এই বোমাগুলি।

এ দিকে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বোমা উদ্ধার হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে সেখানকার নিরাপত্তা নিয়েও। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিক মণ্ডল বলেন, “ছুটিতে রয়েছি। ঘটনার কথা জানি না।” অন্য দিকে, বর্তমানে জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি সিএমওএইচ (৩) গুরুদাস পাত্র বলেন, “ঘটনার কথা জানি না। আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি, ঠিক কী হয়েছে।” তবে, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের চুক্তিভিক্তিক চিকিৎসক সন্তোষ রায় জানান, তিনি ছুটিতে থাকায় এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তাঁর দাবি, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোয়ার্টারের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই যে চারদিন আমাকে ওখানে থাকতে হয়, চেম্বারেই রাত কাটাই। কোয়ার্টারে বোমা মজুত রাখার খবর পেয়ে আতঙ্কে রয়েছি।”

আতঙ্গ বাড়ছে জেলাবাসীরও।

জেলার এক বিশিষ্ট নাট্যকর্মীর মন্তব্য, “এ কোন সময়ে বাস করছি আমরা? দুষ্কৃতীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবধি বোমা রাখার দুঃসাহস দেখাতে পারছেন! দুষ্কৃতীরা পুলিশের উপরে একবার নয়, বারবার হামলা করতে পিছু হঠছে না।” তাঁর প্রশ্ন, “যেখানে পুলিশেরই নিরাপত্তা নেই, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে?”

অন্য বিষয়গুলি:

birbhum panic terror parui police assult
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE