এত দিন শিকারিরা ফাঁদ পেতে অপেক্ষায় থাকত। এ বার তারা ফাঁদ পাতল সরাসরি শিকারদের বাড়িতেই।
পুলিশের খাতায়, শিকারির নাম ব্যাঙ্ক জালিয়াত। শিকার: অনলাইনে সড়গড় নন এমন লোকজন।
সিআইডি সূত্রের খবর, নিত্য দিন বেড়ে চলা জালিয়াতিতে সাম্প্রতিকতম সংযোজন বীরভূমের ময়ূরেশ্বর। একটি বিজ্ঞাপনে ঘরে বসে বিনা পরিশ্রমে আয়ের টোপ দিয়েছিল জালিয়াতেরা। বলেছিল, একটি সফ্টওয়্যার বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে। তা দিয়ে আয় করা যাবে প্রচুর টাকা। টোপে পা দিয়ে সফ্টওয়্যার ডাউনলোড করেছিলেন ময়ূরেশ্বরের মদন গুপ্ত নামে ব্যক্তি। তার পরে জালিয়াতেরা জানিয়েছিল, সফ্টওয়্যারে কাজ করতে গেলে তাদের দেওয়া একটি যন্ত্রে এটিএম কার্ড ও পিন দিয়ে ‘লগ-ইন’ করতে হবে। তা-ও করেন মদনবাবু। তার পরেও তিনি দেখেন, যন্ত্র কাজ করছে না। পুলিশের দাবি, তখন জালিয়াতেরা মদনবাবুকে বলে, ওই যন্ত্রটি খারাপ। সেটি বদলে দেওয়া হবে। কথা মতো যন্ত্রটি নিয়ে চলে যায় এক জালিয়াত। মদনবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই ঘটনার পরের দিন তিনি লক্ষ করেন, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৬ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে!
পুলিশ সূত্রের খবর, যন্ত্রটির নাম ‘স্কিমিং মেশিন’। এতে কার্ড ঢোকানো মাত্রই তার তথ্য ইন্টারনেট মারফত চলে গিয়েছিল জালিয়াতদের কাছে। সেই তথ্য একটি ফাঁকা ম্যাগনেটিক কার্ডে (ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড যা দিয়ে তৈরি হয়) ভরতে সেটি মদনবাবুর এটিএম কার্ডের প্রতিলিপি হিসেবে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তা দিয়েই টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। “ঠিক যে ভাবে ভেড়া বা অন্য পশুর ক্লোন করা হয়, একই ভাবে এখানেও কার্ডটির ক্লোন করা হয়েছিল।” বলছেন এক তদন্তকারী অফিসার।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, পুলিশের চোখ এড়াতে জালিয়াতেরা এমন নানা নিত্যনতুন কৌশল বের করে চলেছেন। মদনবাবুর অভিযোগের সূত্র ধরে তদন্তে নেমে সিআইডি-র গোয়েন্দারা ধরেছেন একটি আন্তঃরাজ্য চক্রের চার জনকে। সিআইডি সূত্রের খবর, ২০১৩ সালের শেষ দিকে মদনবাবু পুলিশে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন। প্রথম দিকে তাঁর অভিযোগের কিনারা করতে কার্যত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিল পুলিশ। কিন্তু মাসখানেক আগে ফোন এবং অন্য কয়েকটি সূত্র মারফত এই আন্তঃরাজ্য প্রতারণা চক্রের খোঁজ মেলে। তার সূত্র ধরেই সম্প্রতি ভিন্ রাজ্যের এক বাসিন্দা-সহ চার জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
ভবানীভবন সূত্রের খবর, ধৃতদের নাম সম্রাট পোদ্দার, মিঠুন চট্টোপাধ্যায়, মিজানুর রহমান এবং অরবিন্দ কুমার। চক্রের চাঁই হাবড়ার বাসিন্দা সম্রাট। অরবিন্দ উত্তরপ্রদেশের লালনপুরের বাসিন্দা। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ধৃত সম্রাটই মদনবাবুর কাছে ঘরে বসে টাকা আয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। সে-ই আবার খারাপ অজুহাত দিয়ে স্কিমিং যন্ত্রটি ফেরত নিয়ে গিয়েছিল।
ভবানীভবন সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, এই চক্রের পিছনে আরও অনেকে থাকতে পারে। এমনকী, এর জাল বিদেশেও ছড়ানো রয়েছে বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। কারণ, চক্রের চাঁই সম্রাট আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে থাকত। সেখানকার কোনও অপরাধ-চক্রের হয়ে সে এই দেশে কাজ করছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অপরাধীদের ধরার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এই ধরনের প্রতারণা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কথা বলছেন সাইবার বিশেষজ্ঞেরা। তাঁরা বলছেন, ইদানীং তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘরে বসে নানা ধরনের ব্যবসা বা কাজ করার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষত অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বা গৃহবধূরা এই ধরনের কাজ করে বহু টাকা উপার্জনও করেন। গোয়েন্দারা বলছেন, নতুন এই পেশাকে হাতিয়ার করে টোপ সাজাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। এই ধরনের কাজ দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ব্যাঙ্ক বা ই-মেলের আইডি-পাসওয়ার্ড।
পুলিশের পরামর্শ, এই ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি। যাঁরা কাজ দিচ্ছেন, তাঁদের সম্পর্কেও বিশদে খোঁজ নেওয়া দরকার। সাইবার আইন ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “অনেকেই সহজে বেশি টাকা আয়ের লোভে প্রতারকদের ফাঁদে পা দেন। কী কাজের বিনিময়ে কত টাকা মিলছে, সেটা আগে খতিয়ে দেখা জরুরি। তা না হলে এ ভাবে টাকা আয়ের বদলে ব্যয় হয়ে যেতে পারে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy