Advertisement
১১ জানুয়ারি ২০২৫

কাউন্সিলরের স্বামীর বরাভয়ে বাড়বাড়ন্ত পাঁচ জনের

পুলিশ তাদের টিকিও ছুঁতে পারবে না। কারণ, মাথার উপরে রয়েছে এলাকার দাদার হাত বারবারই এ কথাটা বুক বাজিয়ে বলে বেড়াত পাঁচ মূর্তি। কথাটা যে কতটা সত্যি, ২৮ জানুয়ারি রাতে বুঝতে পেরেছিলেন সালকিয়ার বিবিবাগানের বাসিন্দারা। সে রাতেই ওরা পাঁচ জনে মিলে অরূপ ভাণ্ডারী এবং অভিজিৎ ঘোষের উপরে চড়াও হয়েছিল বলে অভিযোগ। এবং সেই রাতেই এলাকার মানুষ গিয়েছিলেন গোলাবাড়ি থানায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৫
Share: Save:

পুলিশ তাদের টিকিও ছুঁতে পারবে না। কারণ, মাথার উপরে রয়েছে এলাকার দাদার হাত বারবারই এ কথাটা বুক বাজিয়ে বলে বেড়াত পাঁচ মূর্তি।

কথাটা যে কতটা সত্যি, ২৮ জানুয়ারি রাতে বুঝতে পেরেছিলেন সালকিয়ার বিবিবাগানের বাসিন্দারা। সে রাতেই ওরা পাঁচ জনে মিলে অরূপ ভাণ্ডারী এবং অভিজিৎ ঘোষের উপরে চড়াও হয়েছিল বলে অভিযোগ। এবং সেই রাতেই এলাকার মানুষ গিয়েছিলেন গোলাবাড়ি থানায়। তাঁদের দাবি, পাঁচমূর্তির নামধাম বলার পরেও থানা এফআইআর নেয়নি। পরদিন এলাকার মানুষ প্রতিবাদে বেনারস রোড অবরোধ করেন। তখন চাপে পড়ে থানা পাঁচ জনের নামে অভিযোগ নিতে বাধ্য হয়। আর এর পরেই আসরে নামেন এলাকার সেই দাদা।

কী রকম?

অরূপের বাবা প্রতাপবাবুর অভিযোগ, “ওই দিন (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে আমাকে এলাকার ‘তারা ক্লাবে’ ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে এলাকার কাউন্সিলরের স্বামী, তৃণমূল নেতা সুভাষ র্যাফেল হাজির ছিলেন। তিনি আমাকে অভিযোগ তুলে নিতে বলেন। বলেন, সব মিটিয়ে নিলে অরূপের চিকিৎসার সব খরচ তাঁরা দিয়ে দেবেন।” প্রতাপবাবু অবশ্য ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

শুধু প্রতাপবাবু বা তাঁর পরিবারই নয়, এলাকার বাসিন্দারাও এক বাক্যে জানিয়েছেন, সুভাষবাবুর মদতেই বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল পাঁচ জনের। প্রতিবাদ করলে দেখে নেওয়ার হুমকি দিত ওরা। আর এই ভয়েই কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছিল বিবিবাগান। সুভাষবাবু অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “আমি ওই পাঁচজনকে চিনিই না।”

সুভাষবাবু যাদের চেনেন না, কিন্তু এলাকার মানুষ হাড়ে হাড়ে চেনেন সেই পাঁচ মূর্তির পরিচয় কী? এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বিবিবাগানের ওই পাঁচ যুবক হল সন্দীপ তিওয়ারি, আনন্দ প্রসাদ, শুভম দুবে, বরুণ শর্মা এবং রাজু তিওয়ারি। স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই পাঁচ জন বিবিবাগান এলাকার হৃষীকেশ ঘোষ লেনের ‘তারা ক্লাব’-এর সক্রিয় সদস্য। অভিযোগ, গত ২৬ জুলাই সুভাষ র্যাফেলের মদতেই ক্লাবটি দখল করেছিল ওদের দলবল। এর পর থেকে ওই ক্লাবকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল ‘দাদাগিরি’। প্রতিদিন সন্ধে থেকে নেশার আসর বসানো, তোলাবাজি সবই চলত। স্থানীয় বাসিন্দা সমর পাঁজা বলেন, “গত কয়েক মাসে ওদের দাপট খুব বেড়ে গিয়েছিল।” আর এক বাসিন্দা পম্পা সাউয়ের অভিযোগ, “ওদের ভয়ে রাস্তা দিয়ে মহিলারা হাঁটতে পারতেন না।” এলাকার মধ্যে এ সমস্ত কুকর্ম চলছে, জানত না পুলিশ? জবাব মেলেনি পুলিশের কোনও মহল থেকে। এলাকার মানুষ বলেছেন, ভয়ের চোটে কেউই ওই যুবকদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস দেখাননি।

কিন্তু সোমবার সকালে অরূপের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই কিছুটা সাহসী হয়ে উঠেছেন এত দিন মুখে কুলুপ-আঁটা ওই বাসিন্দারাই। ভয় ভুলে এ বার তাঁরা মুখ খুলেছেন। পাঁচ যুবকের বিরুদ্ধে এ দিন প্রতিটি বাসিন্দার একই অভিযোগ। তাঁদের কথায়, “ওদের মাথার উপর কাউন্সিলরের স্বামীর হাত ছিল বলেই প্রতিবাদ করতে ভয় হতো।”

২৮ জানুয়ারি রাতের ঘটনার পর থেকেই তালা বন্ধ ক্লাবটি। কিছু দূরেই হাওড়া ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, ঘটনার দিন সেখানেই দাঁড়িয়ে এক দল তরুণীকে কটূক্তি করছিল ওই পাঁচ যুবক। আর সেই ঘটনারই প্রতিবাদ করেছিলেন সরস্বতী প্রতিমা বিসর্জন দিতে যাওয়া অরূপ ও তাঁর বন্ধু অভিজিৎ। শুরু হয়েছিল গোলমাল। কিন্তু তখনকার মতো বিষয়টি মিটে গেলেও রাতে বাড়ি ফেরার পথে সন্দীপ-আনন্দ-শুভম-বরুণ ও রাজু তাঁদের আক্রমণ করে। রাস্তায় ফেলে লাঠি, লোহার রড দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় দু’জনকে। এ দিন স্থানীয়েরা বলছেন, “অরূপ ওদের আচরণের প্রতিবাদ করেছিল। তাই খুন করার মতলবেই ওরা রাস্তা আটকে মারধর করেছিল।” ঘটনার দিন রাতে রক্তাক্ত অবস্থায় অরূপকে উদ্ধার করে গোলাবাড়ি থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয়েরা। কিন্তু অভিযোগ, পাঁচ যুবকের বিরুদ্ধে এফআইআর নিতে অস্বীকার করেছিল পুলিশ। কিন্তু কেন? পুলিশ কর্তারা সদুত্তর না দিলেও বাসিন্দারা বলছেন, “কাউন্সিলরের স্বামী তথা দাপুটে নেতার ঘনিষ্ঠ ছেলেদের নামে পুলিশ অভিযোগ নেবে না, এটাই স্বাভাবিক।”

স্থানীয় সূত্রের খবর, ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত ওই পাঁচ যুবকের বাড়িতেও তালা ঝুলছে। মূল অভিযুক্ত আনন্দ প্রসাদের বয়স বছর ২০। মা ও তিন ভাই বোনের সঙ্গে ১২/৭ হৃষীকেশ ঘোষ লেনের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকে সে। দুই বছর আগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে রঙের কারখানায় কাজ করত। আবার এক বছর আগে পঞ্জাব থেকে বেনারস রোডে ভাড়া এসেছে বরুণ শর্মা। বছর ১৯-এর এই যুবক কলেজপড়ুয়া। হৃষীকেশ ঘোষ লেনেরই বাসিন্দা রাজু তিওয়ারি কোনও কাজ করে না। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের বাসিন্দা বছর ২২-এর সন্দীপ থাকে সীতানাথ বোস লেনে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতে না পেরে এখন ভাড়ার গাড়ি চালায়। বছর ২০-র শুভম পেশায় লরির খালাসি।

ঘটনার পরে ছ’দিন কেটে গেলেও এদের এক জনেরও নাগাল পায়নি পুলিশ। তাদের বক্তব্য, এরা সকলেই এলাকাছাড়া।

এ দিন পুলিশের কাছে অরূপের প্রতিবেশীদের একটাই প্রশ্ন ছিল, ‘প্রতিবাদী ছেলেটার মৃত্যুতেও কি কারও চোখ খুলবে না?’

অন্য বিষয়গুলি:

anand prasad raju tiwary barun sharma subham dubey sandip tiwary protest against eve teasing bibibagan salkia hrishikesh ghosh lane arup bhandari murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy