বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশকর্তার ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই প্রশ্নের মুখে পড়লেন সারদার এক প্রাক্তন কর্মী, “আয়, বস। ঠিক করে বল দেখি, কত টাকা হাতিয়েছিস?”
এর পর ঘণ্টা খানেক ধরে চলল জেরা। হাজার চেষ্টা করেও সারদার টাকা লেনদেনের সফটওয়্যারের কাজটা পুলিশকে বোঝাতে পারলেন না ওই কর্মী!
কয়েক মাস পরে শহরের এক অতিথিশালায় ওই কর্মীকেই জেরা করেন ‘সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস’ (এসএফআইও)-এর অফিসারেরা। সামনে খোলা ল্যাপটপ। প্রথম প্রশ্ন, “আপনি তো এমবিএ। স্পেশ্যাল পেপার কী ছিল?” জবাব পাওয়ার পরে আর সময় নষ্ট না করে সরাসরি টাকা লেনদেনের হিসেবে চলে গেলেন তদন্তকারীরা। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ল্যাপটপে যাচাইও করছিলেন তাঁদের কেউ কেউ। ওই কর্মী বলছেন, “আমাদের সংস্থার সফটওয়্যারের মতোই একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করছিল এসএফআইও। ফলে কোনও ভুল তথ্য দেওয়ার উপায় ছিল না।”
বিভিন্ন সময় পুলিশ, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), এসএফআইও, আয়কর দফতর, কেন্দ্রীয় শুল্ক দফতর এবং সেবি-র তদন্তের মুখোমুখি হওয়া সারদার প্রাক্তন কর্মীরা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদ-তদন্তে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির ফারাক এটাই। কী সেই ফারাক?
সারদার এক প্রাক্তন কর্মী জানান, বিধাননগর পুলিশ ঠিক কী তদন্ত করতে চাইছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় সেটাই ঠিক বোঝা যেত না! “তিন মাস ধরে তিনশো রকমের প্রশ্ন ওরা করে গিয়েছে। কখনও কখনও নিজেদের চোর-ডাকাত মনে হত!”বলেন ওই কর্মী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির সামনে বসে তিনি বুঝতে পারেন, নির্দিষ্ট আইন না মেনে সারদা কর্ণধার যে যে কারচুপি করেছিলেন, তা ধরার জন্য তৈরি হয়েই এসেছেন তদন্তকারীরা। ওই কর্মী জানান, কোম্পানি আইনের বিভিন্ন ফাঁক গলে কী ভাবে আমানতের টাকা এ দিক-ও দিক হয়েছে, মূলত তা বের করতেই এসএফআইও-র তদন্ত সীমাবদ্ধ থেকেছে। ইডি আবার ‘মানি লন্ডারিং’ আইন এবং হাওয়ালা বা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের ব্যাপারে খোঁজখবর করেছে। ওই কর্মীর কথায়, “জেরার সময় তদন্তকারীদের ব্যবহারও ছিল ভদ্র। তাঁরা যে ওই বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করে এসেছেন, সেটাও বুঝেছিলাম।” কিন্তু পুলিশের জেরার সময় এক বারও তা বোঝা যায়নি।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারাও বলছেন, এই ধরনের আর্থিক তদন্তের ক্ষেত্রে আর পাঁচটা অপরাধের কায়দায় তদন্ত করলে চলে না। বরং সংস্থার টাকা লেনদেন, কর বিষয়ে পেশাদারদের সাহায্য নিয়েই তদন্তে এগোতে হয়। ইডি এবং এসএফআইও-র তদন্তকারী দলে পুলিশ অফিসার ছাড়াও চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ফরেন্সিক অডিট বিশেষজ্ঞ, রেভিনিউ সার্ভিসের অফিসারেরা থাকেন। থাকেন একাধিক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞও। তার ফলে অভিযুক্ত সংস্থার আর্থিক লেনদেনের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে সুবিধা হয়। কাজটাও নিখুঁত ভাবে করা যায়।
সারদা-কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরে ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল ওই ঘটনার তদন্তের জন্য রাজ্যে ঘটা করে ডিজি-র নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গড়া হয়েছিল। ডিজি ছাড়াও সেই দলে এডিজি (সিআইডি), বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার-সহ ১২ জন আইপিএস ছিলেন। ছিলেন অর্থ দফতরের যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার এক অফিসার ও সিআইডি-র আইনি উপদেষ্টাও। ডিএসপি, ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অফিসারদেরও সিটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারদেরও ওই দলে নেওয়া হয়। কিন্তু কর কিংবা অডিট বিশেষজ্ঞ বা তথ্যপ্রযুক্তির কোনও পেশাদারকে নেওয়া হয়নি। সরকারি নির্দেশে অবশ্য বলা হয়েছিল, সিট ইচ্ছে করলে কর, শুল্ক কিংবা কোনও চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সাহায্য নিতে পারে। কিন্তু তেমন কোনও পেশাদার বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া হয়েছে কি না, তা সিটের সদস্যেরাও জানাতে পারেননি। এক সঙ্গে বসেছে তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সিট আলোচনা করেছে, এমনটা ঘটনাও স্মরণ করতে পারছেন না তাঁরা।
সিট-এর গঠনেই যে খামতি ছিল, তা মেনে নিচ্ছেন রাজ্যের পুলিশকর্তারা। তাঁরা বলছেন, তদন্তভার দেওয়ার বদলে সিট-কে যাবতীয় মামলা তদারকির কাজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক মামলা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ছিলেন না সিট-এ। এক পুলিশ অফিসারের মন্তব্য, “তথ্যের গন্ধমাদনের মধ্যে বিশল্যকরণী চিনতেই পারিনি আমরা!” এই তদন্তে এক অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা বলেই ফেলেন, “জীবনে এই ধরনের মামলা প্রথম করছি!”
এই কথায় সত্যতা টের পেয়েছিলেন জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়া সারদার আর এক কর্মীও। তিনি বলেন, “সারদার টাকা কারা পেল, তা না জেনে প্রথমে বিধাননগরের পুলিশ সুদীপ্ত সেনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করত।” তবে মাস কয়েক পর ফরেন্সিক অডিট সংস্থার পরামর্শ নিয়ে প্রশ্নের ধরন বদলেছিল পুলিশ। ওই কর্মী বলেন, “কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি টাকা লেনদেনের নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্য কোনও প্রশ্নই করত না।”
তদন্তে নেমে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) কর্তারা দেখেছেন, সারদা-কাণ্ডে সংস্থার মূলধন কোথায় গেল, তা নিয়ে সে ভাবে খোঁজখবরই নেওয়া হয়নি! বরং কোন কর্মীর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা জমা পড়েনি, কোথায় কর্মীরা বেতন পাননি এ সব নিয়েই মামলা রুজু হয়েছে! যা দেখে এক তদন্তকারীর মন্তব্য, “আসল কারণ ছেড়ে ছুটকো-ছাটকা বিষয় নিয়েই মাথা ঘামিয়েছে এ রাজ্যের পুলিশ। আদতে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কোথায় গেল কিংবা কেন আমানতকারীরা টাকা ফেরত পেলেন না, সেটাই এই তদন্তের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হওয়া উচিত।”
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলছেন, এ ধরনের তদন্তে রাজ্য পুলিশের সাধারণ কর্মী-অফিসারদের পারদর্শিতা না-ই থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা সিবিআই কিংবা ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থার সাহায্য নিতে পারত। কিন্তু তা করা হয়নি। উল্টে সারদার তদন্তে নেমে প্রথম দিকে বিধাননগর কমিশনারেটের কর্তাদের বিরুদ্ধেই অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছিল ইডি। এ নিয়ে আদালতে অভিযোগও জানিয়েছিল তারা।
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে গত এক বছরে কী কাজ করল সিট? স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি সিট-এর সদস্যেরা। তাঁরা বলছেন, গোড়াতে সিট কয়েক বার বৈঠকে বসলেও পরে আর তা হয়নি। সিট কবে শেষ বৈঠক করেছে, তা-ও কেউ মনে করতে পারছেন না। সিট-এর সদস্য এমন কয়েক জন সিআইডি অফিসারকে জেলার এসপি পদেও বদলি করা হয়। ফলে কাজ প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। তবে সিট-এর কোনও কোনও সদস্য বলছেন, বেশ কিছু মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সারদার বিরুদ্ধে প্রায় ৩২০টি মামলা ছিল। তার মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সারদা-কাণ্ডে কলকাতা পুলিশের ১০টির মধ্যে ৭টি মামলায় চার্জশিট হয়েছে বলে পুলিশের দাবি।
কিন্তু তাতে আখেরে কী লাভ হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সারদার প্রাক্তন কর্মীদের মধ্যেই। তাঁরা জানিয়েছেন, সারদা নিয়ে সব চেয়ে বেশি জেরা করেছে বিধাননগর কমিশনারেট। বেশির ভাগ তথ্যও তাদেরই হাতে। কিন্তু সেই তথ্য টাকা উদ্ধারে লাগানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান সারদারই এক প্রাক্তন কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy