চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত দু’বছরের আয়ব্যয়ের হিসেব এবং অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
নবান্নের অনুমোদন পাওয়ার পর বুধবার রাতে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সম্মতির জন্য এই প্রস্তাব রাজভবনে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবারই তাতে সম্মতি দিয়েছেন রাজ্যপাল। ফলে আগামী দু’এক দিনের মধ্যে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ২০১১-’১২ এবং ২০১২-’১৩ আর্থিক বছরের আয়ব্যয়ের হিসেব এবং অডিট রিপোর্ট বিধানসভার পেশ করতে পারেন বলে অর্থ দফতর সূত্রে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁর সরকারের আয়ব্যয়ের হিসেব জনসমক্ষে আনেননি মুখ্যমন্ত্রী। গত তিন বছর ধরে প্রকাশ করা হয়নি কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর অডিট রিপোর্টও। আর্থিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এমন অনিয়ম দেখে গত তিন বছরে অন্তত বার দশেক তাগাদা দিয়েছে সিএজি। কিছু দিন আগে সিএজি-র কর্তারা দিল্লি থেকে এসে রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের সঙ্গে দেখা করে এ নিয়ে তাঁদের অসন্তোষও জানিয়ে গিয়েছিলেন। গত ২৭ জুন চলতি আর্থিক বছরের হিসেব সম্পূর্ণ করার বৈঠকেও নবান্নে এসে রাজ্যের প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (পিএজি) স্টিফেন হংরে আয়ব্যয়ের হিসেব ও অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য অর্থ দফতরের কর্তাদের অনুরোধ করেন। বিরোধী দলগুলিও এ নিয়ে সরকারের উপরে চাপ বাড়াচ্ছিল। তার জেরেই অবশেষে সরকার নড়েচড়ে বসেছে বলে অর্থ দফতরের কেউ কেউ মনে করছেন।
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও আর্থিক বছরের খরচের হিসেব সম্পূর্ণ হওয়ার পর সিএজি তা রাজ্যপালের মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করে। একই ভাবে পেশ করা হয় সিএজি-র বার্ষিক অডিট রিপোর্টও। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচিত সরকারকেই প্রথমে তা প্রকাশ্যে আনতে হয়। সে জন্য সরকার বিধানসভায় আয়ব্যয়ের হিসেব ও অডিট রিপোর্ট পেশ করতে বাধ্য। বিধানসভায় রিপোর্ট পেশের দিনই সিএজি-র তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে সরকারি খরচের অনিয়মের বিষয়গুলি রাজ্যবাসীকে জানানো হয়।
অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “সংবিধান অনুযায়ী, হিসাবপত্র এবং অডিট রিপোর্ট সরকার যত ক্ষণ না বিধানসভায় পেশ করছে, তত ক্ষণ তা অত্যন্ত গোপনীয় বলে বিবেচিত হয়। বিধানসভায় পেশের পর সবাই ওই রিপোর্ট দেখতে পারেন।” রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই হিসেব প্রকাশ্যে আনেনি বর্তমান সরকার। প্রকাশ করা হয়নি অডিট রিপোর্টও।
কিন্তু কেন সরকার এত দিন এই রিপোর্ট পেশ করেনি? অর্থ দফতর সূত্রের খবর, সিএজি অডিট রিপোর্টে বেশ কয়েকটি দফতরের বেহিসেবি খরচ, অতিরিক্ত খরচ এবং সরকারি টাকার গরমিল ও নয়ছয় চিহ্নিত করেছে। সেই কারণেই সরকার বিষয়গুলি প্রকাশ্যে আনতে চাইছিল না। সাম্প্রতিক অতীতে টু-জি থেকে কয়লা কেলেঙ্কারির ঘটনা সিএজি রিপোর্টের সূত্র ধরেই সামনে এসেছে। সরকারের আশঙ্কা, সিএজি রিপোর্ট বিরোধীদের হাতে বড় অস্ত্র হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর থেকে আয়ব্যয়ের হিসেব ও অডিট রিপোর্ট প্রকাশে রাজি ছিলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তা হলে এখন অবস্থান বদল কেন? অর্থ দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, ২০১১ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকার তিন বছর পার করেছে। তার মধ্যে ২০১১-’১২ এবং ২০১২-’১৩ সালের হিসেব এবং অডিট রিপোর্ট চূড়ান্ত করার কথা সিএজি আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। ২০১৩-’১৪ সালের হিসেবও চূড়ান্ত হওয়ার পথে। আগামী মাসেই তা রাজ্যকে পাঠিয়ে দেবে সিএজি। কিন্তু এর পরেও রাজ্য এ নিয়ে পদক্ষেপ না করায় বিরক্ত ওই হিসেব পরীক্ষক সংস্থা। দেশের ডেপুটি কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল পি মুখোপাধ্যায় বেশ কয়েক বার রাজ্যের মুখ্যসচিবকে কড়া চিঠি লিখে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। অপর এক ডেপুটি এজি নবান্নে এসে সরকারকে হিসেব পেশ করতে অনুরোধ করে যান। এ ছাড়া, অর্থ কমিশন, যোজনা কমিশনের মতো সংস্থাও কেন্দ্রীয় অনুদান চূড়ান্ত করার আগে আয়-ব্যয়ের হিসেব দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজ্য তা প্রকাশ করছিল না।
অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “এর পরও হিসেব প্রকাশ না করলে কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ হয়ে যেত। ফলে বিধানসভায় হিসেব ও অডিট রিপোর্ট পেশ না করে উপায় ছিল না।” সেই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলার দিকটি সিএজি কী ভাবে বিশ্লেষণ করেছে, তা প্রকাশ্যে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy