মন্ত্রী মদন মিত্রের গ্রেফতারিকে তিনি ‘চক্রান্ত’ বলছেন না। সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কাজ করছে, এমন কথা বলতে তিনি রাজি নন। তিনি বরং বলছেন বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা রাখার কথা। আর মদনের গ্রেফতারি এবং সিবিআইয়ের কাজকর্মের বিরুদ্ধে ধর্না? তাঁর বক্তব্য, সাংসদ হিসেবে গঠনমূলক কাজ করতেই তিনি বেশি আগ্রহী।
বক্তার নাম সুগত বসু। যাদবপুরের তৃণমূল সাংসদ। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে তৃণমূলের হরেক রকম কর্মসূচিতে তাঁকে দেখেনি কেউ। এ বার মুখ খুলে শাসক দলের এই শিক্ষাবিদ-সাংসদ বুঝিয়ে দিলেন, দুর্নীতির অভিযোগে ফেঁসে থাকা দলের সাম্প্রতিক কাজকর্মের সঙ্গে তিনি দূরত্বই বজায় রাখতে চান। নিজেকে প্রায় তৃণমূলের মূল স্রোত থেকে আলাদা করেই দলের গতে-বাঁধা লাইনের বাইরে বেরিয়েছেন সুগতবাবু। সারদা-কাণ্ডের তদন্তের প্রতিবাদে যারা সিবিআইয়ের আঞ্চলিক দফতর থেকে দিল্লি সর্বত্র ধর্নায় বসেছে, ধৃত মন্ত্রীকে আদালতে পেশ করা হলে যাদের আইনজীবীরা এজলাসেই হইচই করেছেন, সেই তৃণমূল এ দিন আরও বিব্রত দলেরই সাংসদের এমন বক্তব্যে। আর সেই বক্তব্যকে প্রায় লুফে নিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন বিরোধীরা!
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের পরে রবিবার সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে সাম্প্রতিক সব বিষয়ে খোলাখুলি নিজের মত জানিয়েছেন সুগতবাবু। যা একেবারেই তৃণমূল এবং আরও স্পষ্ট করে বললে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক মতের সঙ্গে মেলে না! রাজ্যে পরিবর্তনের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতাই বিদেশে পড়াতে ব্যস্ত সুগতবাবুকে প্রেসিডেন্সির মেন্টরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তার পরে দলের মধ্যে একাংশের অনাগ্রহ সত্ত্বেও যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে তাঁকে প্রার্থী করেন। তাঁর এ দিনের বক্তব্য শুনে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ একান্ত আলাপচারিতায় বলতে শুরু করেছেন, ‘অরাজনৈতিক’ মুখকে রাজনীতির আঙিনায় টেনে আনলে কী ফলভুগতে হয়, যাদবপুরেরই আরএক প্রাক্তন সাংসদ কবীর সুমনের ঘটনায় সেই শিক্ষা নেননি দলনেত্রী! এ বার সুগতবাবু কি তাঁর চোখ খুলতে সাহায্য করবেন?
শাসক দলের অন্দরেই অন্য একাংশের অবশ্য বক্তব্য, শিক্ষা জগতে নিজ গুণে প্রতিষ্ঠিত সুগতবাবু। তাঁর পরিচিতি কখনওই ‘দলসর্বস্ব’ নয়। তাই ‘মনের কথা’ এ ভাবে খোলাখুলি বলতে পেরেছেন তিনি। যার সঙ্গে দলের আরও অনেকে সহমত হলেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে তা বলতে পারছেন না। তবে একই সঙ্গে এই আশঙ্কাটাও শুরু হয়েছে, সুগতবাবুর পথ ধরে এ বার আরও কেউ কেউ বেসুরে গাইবেন না তো?
আর পাঁচ জন বিক্ষুব্ধ নেতার মতো সুগতবাবু কিন্তু প্রকট ভাবে কোনও বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরেননি। তিনি শুধু সুষ্ঠু পদ্ধতি এবং আইনের ব্যবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কী বলেছেন সুগতবাবু? মদনের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্নে তাঁর বক্তব্য, “যারা সাধারণ মানুষের টাকাপয়সা নয়ছয় করেছে, তাদের সকলের বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা রাখতে হবে আমাদের।” বলা বাহুল্য, এমন বক্তব্য এই মুহূর্তে তৃণমূলের কোনও নেতা-সাংসদের কাছ থেকে অভাবনীয়! সুগতবাবু বলেন, সব দলেই দুর্নীতি আছে। এ সবের বিরুদ্ধে জোরালো জনমত তৈরি করতে হবে।
মমতার অভিযোগ, সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কাজ করছে। সুগতবাবু কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখছেন? যাদবপুরের সাংসদ বলেছেন, “আমার বিশ্বাস, আদালত সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। বিচারব্যবস্থায় আস্থা রাখতে হবে। আমার সামনে তো প্রমাণ নেই, আমি তো কিছু জানি না! আদালতের সামনে প্রমাণ আছে, সেখানেই বিচার হবে।” তিনি উল্লেখ করেছেন, দেশের ৫৪৩ জন সাংসদের মধ্যে ১৮৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে বলে তিনি একটি বইয়ে সম্প্রতি দেখেছেন। এই পরিস্থিতির বদল ঘটিয়ে আরও বেশি ‘সৎ ও দক্ষ’ মানুষ দেশসেবার কাজে এগিয়ে আসবেন বলে তাঁর আশা।
তৃণমূলের ধর্না কর্মসূচি নিয়েই বা তাঁর কী বক্তব্য? সাংসদের উত্তর, “সংসদে যতটা পারি, গঠনমূলক কাজে যুক্ত থাকার চেষ্টা করি। বিতর্ক, বক্তৃতা, স্ট্যান্ডিং কমিটিতে কাজকর্মের চেষ্টা করি। সবাইকে দিয়ে তো সব কিছু হয় না! আমি যে রকম, যে ভাবে কাজ করতে পারি, তা-ই করছি।”
পারিবারিক পরিচয়ে সুগতবাবু নেতাজির বংশধর। সেই নেতাজি ও স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ছবিও দু’টি উৎসবে রাখতে হবে বলে যুবকল্যাণ দফতর নির্দেশিকা জারি করেছে। এ নিয়ে সুগতবাবু বলছেন, “নেতাজি বা স্বামীজির মতো মনীষীরা অন্য স্তরের মানুষ। আজ যে নেতৃবৃন্দ আছেন, তাঁদের সঙ্গে ওই মনীষীদের তুলনা করা ঠিক নয়।”
তাঁর এই বক্তব্যেই স্পষ্ট, কোনও বিষয়েই সরাসরি তৃণমূলকে তোপ দাগেননি সুগতবাবু। কিন্তু কেতাবি ঢঙে যা বলেছেন, দলকে দংশনের জন্য যথেষ্ট! সুগতবাবুর বিবেককেই স্বাগত জানান বিরোধী নেতারা। যাদবপুরে সুগতবাবু যাঁকে হারিয়েছেন, সেই সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “শিক্ষিত মানুষ। ঠিকই বলেছেন। আদালতের নির্দেশেই যে সিবিআই সারদার তদন্ত করছে, সেটাই তো তৃণমূল নেত্রী মানছেন না! সুগতবাবু বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা রাখতে বলেছেন।” যাঁর দায়ের করা মামলায় সিবিআই তদন্তের আদেশ হয়েছিল, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান আরও এগিয়ে বলছেন, “শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তৃণমূলেও আছেন। তৃণমূল নেত্রীর অসংসদীয় কার্যকলাপ যাঁরা মানতে পারছেন না, সুগতবাবু মুখ খোলার পরে তাঁরাও এগিয়ে আসুন!” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও বক্তব্য, “দেরিতে হলেও সাহসে বুক বেঁধে তিনি সত্য কথন করেছেন। ওঁর দল আদালতে আস্থা না রাখলেও তিনি রেখেছেন।”
সুগতবাবুর বক্তব্যে বিড়ম্বিত তৃণমূল নেতৃত্ব এ দিন অন্তত আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খুলতে চাননি। তাঁরা চাইছেন, বিষয়টি দলনেত্রীর নজরে আসুক। দলের এক রাজ্য নেতার আক্ষেপ, “এই ছিল আমাদের কপালে! কখনও কবীর সুমন, কখনও সুগতবাবুদের ঘাড়ে করে জিতিয়ে আনব। তার পরেই তাঁদের বিবেক জেগে উঠে দলকে ডুবিয়ে দেবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy