দু’টি ফোনকল। একটি পেয়েছিলেন কলকাতার এক হোটেল-মালিক। অন্য ফোনটি ‘কলার’ করেছিলেন কলকাতার বাড়িতে নিজের মা-কে। কলকাতা পুলিশের হাতে থাকা ওই দু’টি টেলিফোন-কথোপকথনের রেকর্ডিং কলকাতারই পার্ক সার্কাসের আমির রেজা খানকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) মনে করছে। কারণ, কলকাতায় ওই দু’টি ফোনকল-ই করেছিলেন আমির রেজা স্বয়ং।
এনআইএ-র বক্তব্য, বিলেতের বিমানবন্দরে সম্প্রতি ধরা পড়া সন্দেহভাজন যুবক ভারতের অন্যতম ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি তথা ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আমির-ই কি না, সেই ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে তাঁর গলার স্বরের সঙ্গে রেকর্ড করে রাখা ওই টেলি-কণ্ঠস্বর মিলিয়ে দেখে। আমিরের স্বরের ওই দু’টি রেকর্ডিং এনআইএ-র মাধ্যমে বিলেতে পাঠানো হবে নাকি কলকাতা পুলিশের একটি দল সেই রেকর্ডিং নিয়ে সেখানে রওনা দেবে, সেই ব্যাপারে এখন চিন্তাভাবনা চলছে। ইতিমধ্যেই কলকাতা পুলিশের একটি দল আমিরের বিরুদ্ধে রুজু হওয়া বিভিন্ন মামলার কাগজপত্র ও অন্যান্য নথি নিয়ে দিল্লি গিয়েছে।
পুলিশ জানায়, বেনিয়াপুকুর এলাকার মফিদুল ইসলাম লেনের বাসিন্দা, ইমারতি দ্রব্য সরবরাহকারী ইশাক খানের মেজ ছেলে আমিরের দাদা আসিফ রেজা খান ২০০১-এর জুলাই মাসে খাদিমকর্তা পার্থ রায়বর্মনের অপহরণের ঘটনায় জড়িত ছিলেন। গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, ওই মুক্তিপণের টাকার একাংশ গিয়েছিল ৯/১১-র হামলাকারীদের হাতে। সে বছরই গুজরাত পুলিশের গুলিতে নিহত হন আসিফ। এর বদলা নিতে আমির, আফতাব আনসারিরা ‘আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্স’ নামে এক বাহিনী গড়ে তোলে এবং তারাই ২০০২-এর জানুয়ারিতে কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের সামনে হামলা চালিয়ে পাঁচ পুলিশকে হত্যা করে। সে বছরই আফতাব, জামিলউদ্দিন নাসিরেরা ধরা পড়লেও অধরা থেকে যান আমির। বছর পাঁচেকের মধ্যে কর্নাটকের রিয়াজ ভটকল, ইকবাল ভটকলদের সঙ্গে মিলে আমির তৈরি করেন দেশজ জঙ্গি সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’, যার সদস্যেরা কেউই সীমান্তের ও পার থেকে আসা নন। বহু নাশকতায় নাম জড়িয়েছে ওই সংগঠনের।
আমিরের বয়স এখন বছর ছত্রিশ। তাঁকে ধরে দিতে পারলে ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে এনআইএ। পার্ক সার্কাসের বাড়িতে আমিরের মা ও ছোট ভাই-সহ আত্মীয়েরা রয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রের খবর। তাঁর বাবা কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন।
লালবাজারের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর দাবি, ২০১৩-র জানুয়ারি ও ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে আমির নিজেই দু’বার কলকাতায় ফোন করেছিলেন। আর সেই দু’টি ফোনকল রেকর্ড করে রেখেছেন গোয়েন্দারা। লালবাজার সূত্রের খবর, গত বছর জানুয়ারি মাসে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ার বন্দর-শহর মোম্বাসা থেকে আমির ফোন করেন মফিদুল ইসলাম লেনে থাকা তাঁর মায়ের মোবাইলে।
আবার ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে আমির দক্ষিণ কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলের মালিক-সহ শহরের কয়েক জন ব্যবসায়ীকে ফোন করে মোট ৪০ কোটি টাকা তোলা চান বলে অভিযোগ ওঠে। এই ব্যাপারে ভবানীপুর ও শেক্সপিয়র সরণি থানায় মামলাও রুজু করা হয়। এর মধ্যে ওই পাঁচতারা হোটেলের মালিককে ফোন করার তিন দিন পর ফের সেখানকার এক শীর্ষকর্তাকে তোলা চেয়ে হুমকি দিয়ে আমির ফোন করেছিলেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি। লালবাজার সূত্রের খবর, এসটিএফ সেই কলটি রেকর্ড করেছিল। তদন্তকারীদের বক্তব্য, ওই ফোনটি আমির করেছিলেন লুক্সেমবর্গ থেকে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র বক্তব্য, আমিরকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে স্কাইপ-এর মাধ্যমে ভিডিও চ্যাট-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিলেতে ধরা পড়া ওই যুবককে কলকাতায় বসে কম্পিউটারের পর্দায় দেখেই আমিরের কোনও আত্মীয় বা বন্ধু বলে দিতে পারেন, তিনি সত্যিই আমির নাকি অন্য কেউ। কিন্তু গোয়েন্দাদের একাংশের বক্তব্য, আটক যুবক আমির হলেও তাঁকে যাতে গ্রেফতার না করা হয়, সে জন্য তাঁর আত্মীয় কিংবা কোনও পরিচিত বেমালুম ব্যাপারটা চেপে যেতে পারেন। হয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমিরকে তাঁরা শনাক্ত করবেন না।
এনআইএ-এর গোয়েন্দাদের একাংশ আবার ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণের কথা ভাবছেন। তবে সে ক্ষেত্রে কলকাতায় আমিরের বাড়ির লোক ও ব্রিটেনে আটক সেই যুবকের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু কোনও এক পক্ষ আপত্তি জানালে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে বিচারকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে তদন্তকারীদের। তাই, শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া হিসেবে ডিএনএ পরীক্ষা সব চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হলেও গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে অনেকটা সময় লেগে যেতে পারে।
আর ওই সব জটিলতার কারণেই গোয়েন্দাদের একাংশ আপাতত ভরসা রাখছেন ‘ভয়েস ম্যাচিং’-এর পদ্ধতির উপর। ওই যুবক আমির নাকি অন্য কেউ, সেটা বোঝার জন্য। এনআইএ-র এক অফিসার বলেন, “রেকর্ড করে রাখা আমিরের ওই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে ওই যুবকের স্বর বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।”
স্বর মেলানো হোক বা ডিএনএ পরীক্ষা কিংবা স্কাইপ-এর মাধ্যমে ভিডিও চ্যাট বিলেতে ধরা পড়া যুবক কলকাতার আমির রেজা খান কি না, তা জানতে কলকাতা পুলিশের বড় ভূমিকা থাকবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy