দৃষ্টিতে শুধুই উদ্বেগ। শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।
ছেলের বয়স বারো। মেয়েটি সাত।
দুই সন্তানকে নিয়ে মাথা গোঁজার জন্য দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছেন এক মা। সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আত্মীয়েরা তাড়িয়ে দিয়েছে। কোথাও ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলে কিছু দিনের মধ্যেই পরিচয় জেনে পত্রপাঠ বিদায় করে দিচ্ছেন বাড়ির মালিক। কারণ, তিনি সুদীপ্ত সেনের পুত্রবধূ প্রিয়াঙ্কা সেন!
স্বামী শুভজিৎ জেলে। সন্তান ছাড়াও তাঁর কাঁধে এখন শাশুড়ি আর ছোট ননদের দায়িত্ব। এই মূহূর্তে যে বাড়িতে থাকেন, তিন দিনের মধ্যে তা-ও ছেড়ে দেওয়ার ফরমান এসেছে। এর পর দু’টি বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন, ভাবতে গিয়ে কেঁদেই ফেলছেন প্রিয়াঙ্কা। কোনও রকমে নিজেকে সামলে বললেন, “আমার দুই ছেলে-মেয়ে কী অপরাধ করল!”
রবিবার প্রিয়াঙ্কাকে সল্টলেকের অফিসে ডেকে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর অফিসারেরা। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে রাতে বেহালার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখেন ছেলে-মেয়ে কেউ নেই! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। সকালে ইডি অফিসারদের সঙ্গে যখন রওনা দিয়েছিলেন, তখন ছেলেমেয়ের সঙ্গে ফ্ল্যাটেই ছিলেন শুভজিতের এক বন্ধু। বেরোনোর আগে ছেলেকে বলে গিয়েছিলেন, “বোনকে খাইয়ে নিস। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।”
কিন্তু গেল কোথায় তারা? খোঁজ করতে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা জানতে পারেন, তিনি চলে যাওয়ার পরে শুভজিতের বন্ধুটি ওদের রেখে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তার পরপরই আবাসনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এজেন্সির কেউ এক জন ঘরে এসে বলেন, “নীচে প্রচুর মিডিয়া এসেছে। তোমরা পালিয়ে যাও।” বাড়িতে বাবা নেই, মা নেই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ছোট বোনের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিল দাদা। তার পর গেট পেরিয়ে দে দৌড়! প্রিয়াঙ্কা বলেন, “ছেলে আমাকে বলেছে, ওরা কিছুটা দূরে একটি ট্রাফিক স্ট্যান্ডে গিয়ে বসে পড়েছিল। ওর হাতে একটা মোবাইল ছিল। কিন্তু তাতে টাকা ছিল না। ফলে চাইলেও কাউকে ফোন করতে পারেনি।” তিনি বলে চলেন, “ওই গরমে ওদের কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকতে দেখে এক অটোচালকের দয়া হয়। তিনি ওদের গাড়িতে তুলে নেন, মোবাইলে টাকা ভরে দেন। তার পর আমার এক বন্ধুকে ফোন করে ওঁর কাছে পৌঁছে যায় ওরা। রাতে খবর পেয়ে দু’জনকে বাড়িতে আনি।”
আপনার বাপের বাড়ির লোকেরা কোথায়? হেসে ফেলেন প্রিয়াঙ্কা। বলেন, “বাবা-মায়ের ডিভোর্স অনেক দিন আগেই হয়েছে। বাবা অন্য সংসার পেতেছেন। মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। আমিই তাঁর দেখাশোনা করি।” সারদার কালো ছায়া সংসারে নেমে আসার পরে বাবার সঙ্গে একবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তিনিও।
সোমবার দুপুরে শহরের রাজপথে একটি গাড়ির ভিতরে বসে কথা বলছিলেন বছর তিরিশের বধূ। দৃশ্যতই চোখ-মুখ ফোলা। বলছিলেন, “সুদীপ্ত সেনের দুই স্ত্রীরই দু’টি করে ছেলেমেয়ে। দুই পরিবারের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। সারদা-মামলা সবাইকে এক করে দিয়েছে।” শুভজিৎ প্রথম পক্ষের স্ত্রী মধুমিতার ছেলে। তাঁর ছোট বোনের নামও প্রিয়াঙ্কা। পিয়ালির ছেলে-মেয়েরা ছোট, এখন মামা-দিদিমার কাছে রয়েছে।
সুদীপ্ত গা-ঢাকা দেওয়ার পর শাশুড়ি, ননদ, স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে প্রিয়াঙ্কা চলে গিয়েছিলেন মুম্বই। সেই সময় থেকেই নিয়মিত স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তাঁর দুই সন্তানের। তবে কার্সিয়াং-এর কনভেন্ট স্কুল এবং মুম্বইয়ের কলেজে পড়াশোনা করা প্রিয়াঙ্কা সহজেই চাকরি জুটিয়ে নেন। শুভজিৎ কাজ নেন রেস্তোঁরায়। কয়েক দিন পরে পিয়ালিও তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সেখানে চলে যান। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসটা একই ছাদের তলায় সবাই মিলে ছিলেন। তার পরে পিয়ালি আবার ফিরে আসেন কলকাতায়।
মুম্বই যথেষ্ট ব্যয়বহুল শহর। বাড়িভাড়া গুনে সংসার চালাতে অসুবিধা হচ্ছিল। প্রিয়াঙ্কার কথায়, “তাও মানিয়ে নিয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যে দিন মুম্বইয়ের রেস্তোঁরার মালিক রাজার পরিচয় জানতে পারেন, পরের দিন ওর কাজ চলে যায়। বাধ্য হয়ে জুলাই মাসে ফিরে আসি কলকাতায়।”
সেপ্টেম্বরে মুম্বইয়ে আবার চাকরি পান প্রিয়াঙ্কা। শুভজিৎ থেকে যান কলকাতায়। শাশুড়ি-ননদ-সন্তানদের নিয়ে প্রিয়াঙ্কা এ বার একাই চলে যান মুম্বই। ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। কিন্তু ফের পরিচয় জানাজানি হয়ে চাকরি যায়। আবার কলকাতায় ফেরা। “রাজা ছিল বাবার চোখের মণি। বাবা ওকে কাজ করতে দিতেন না। বলতেন, আমি তো রোজগার করছি। রাজার দিন কাটত ক্রিকেট-কার র্যালি-বন্ধুবান্ধব নিয়ে। আমাদের যে দামি গাড়িটা ছিল, বাবা গ্রেফতার হওয়ার পর সেটা বিক্রি করে ১৪ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম। তার মধ্যে দু’লক্ষ টাকা তোলার পরেই অ্যাকাউন্ট সিল করে দেয় পুলিশ।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চলেন প্রিয়াঙ্কা।
কিন্তু সারদায় জীবনের প্রায় সব সঞ্চয় বিনিয়োগ করে যাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তাঁদের দিনগুলোও আপনার মতো, অথবা তার চেয়েও খারাপ কাটছে... প্রশ্ন শুনে চোখ সরিয়ে নিলেন প্রিয়াঙ্কা। কেলেঙ্কারির আঁচ যে এখন তাঁর গায়েও এসে লাগছে, কপর্দকশূন্য হয়ে আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে। মুখে কিছু বললেন না। শুধু অস্ফুটে বেরিয়ে এল মায়ের মন, “আমার ছেলেমেয়ে তো কোনও দোষ করেনি।” ছোট্ট মেয়েটিকে বলা হয়েছে, বাবা দিদা-মায়ের কাছে গিয়েছে। ছেলে টিভি দেখে জেনেছে, বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। তার পর থেকে কথা বলা আরও কমিয়ে দিয়েছে সে।
কলকাতার এক শুভানুধ্যায়ীর আস্তানায় রয়েছেন শুভজিতের মা মধুমিতা সেন ও তাঁর ছোট মেয়ে। তাঁদের দেখভালের ভারও এখন প্রিয়াঙ্কার উপরে। সোমবার সারদা কমিশনেও সাক্ষ্য দিতে যেতে হয়েছিল। সেখানে দেখা হয়েছে শ্বশুরের সঙ্গে। প্রিয়াঙ্কার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন সুদীপ্ত। বলেছেন, “আমার যা হয় হোক। দেখিস, ওরা রাজাকে (শুভজিৎ) যেন ছেড়ে দেয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy