শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসন সুরক্ষিত রাখার পক্ষে বরাবরই সওয়াল করেন শিক্ষাবিদেরা। এ বার সে কথাই শোনা গেল তৃণমূল সাংসদ সুগত বসুর গলায়। যিনি নিজে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপকও বটে। সাম্প্রতিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্কে অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়েই সুগতবাবু জানিয়েছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা থাকলে তা স্বশাসনের পক্ষে ভাল নয়। সব বিষয়ে সরকারের ‘নাক গলানো’র জেরেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ভারতের ঠাঁই নেই বলে মন্তব্য করেছেন সুগতবাবু।
নালন্দা বিতর্কের প্রেক্ষিতে এই সব মন্তব্য করলেও গোটা দেশের নিরিখেই যে তা সত্য, সে কথা জানিয়েছেন সুগতবাবু নিজেই। অনেকেই মনে করছেন, আলাদা করে এ রাজ্যের নাম উল্লেখ না করলেও তৃণমূল সাংসদ কিন্তু ঘুরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন।
সম্প্রতি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বোর্ডের কাছে চিঠি লিখে সেখানকার আচার্য পদ থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন অমর্ত্য সেন। সরকার তাঁকে ওই পদে চায় না বলেও চিঠিতে ইঙ্গিত দিয়েছেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। সে প্রসঙ্গেই শনিবার কলকাতায় সুগতবাবুর মত জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, “এটা নালন্দার পক্ষে খুবই দুঃখের দিন। এটা আমাদের সকলেরই স্বপ্ন, এশিয়ার সব দেশের সাহায্য নিয়ে পুরনো নালন্দার খুব কাছে একটা সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে। এবং অধ্যাপক অমর্ত্য সেন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বলেই আমরা যথেষ্ট আন্তর্জাতিক সমর্থনও পাচ্ছিলাম।”
এর পরেই শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ টেনে আনেন সুগতবাবু। জানান, গত ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি নালন্দার গভর্নিং বোর্ডের বৈঠকেই স্থির হয়েছিল যে দ্বিতীয় বারের জন্যও অমর্ত্য সেনকেই আচার্য পদে রাখা হবে। অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটর, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে নাম পাঠানোও হয়। কিন্তু এক মাসের বেশি সময় কেটে গেলেও তা নিয়ে জবাব আসেনি। শনিবার কলকাতায় অমর্ত্যবাবুকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ফের জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বশাসন না ফিরলে নালন্দার আচাযর্র্ হিসেবে থাকার কোনও ইচ্ছেই তাঁর নেই।
এ প্রসঙ্গে সুগতবাবুও বলেন, “আমাদের দেশে সরকার যদি নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের কাগজ ভিজিটরের সামনে না রাখেন তা হলে তিনি সেটাতে সই করতে পারেন না। সরকারের এই ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের পক্ষে ভাল নয়।”
অমর্ত্য নিজেও সরকারের এই ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। দেশ জুড়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলছে বলেও খেদ প্রকাশ করেন তিনি। শনিবার সুগতবাবুর বক্তব্যেও তারই প্রতিফলন ঘটেছে। তা হলে কি তাঁর মনে হয় শিক্ষার থেকে রাজনীতিকরণটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে? সুগতবাবুর জবাব, “বিশ্বের প্রথম দু’শোটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ভারতের একটিও নেই। এর পিছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে সরকারের বড্ড বেশি নাক গলানো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও বেশি স্বশাসন দিলে ভাল হতো।”
সুগতবাবু আলাদা ভাবে উল্লেখ না করলেও তাঁর এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ চলেই আসছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কারা বসবেন, বাম আমলে তা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের দলীয় কার্যালয়ে ঠিক হতো বলে অভিযোগ। এ আমলেও তৃণমূল ঘনিষ্ঠরাই বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল পদে আছেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাসক দলের কর্মচারী ও ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্য। গত মঙ্গলবারই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলের কর্মচারী সংগঠনের হাতে হেনস্থা হন সেখানকার উপাচার্য-সহ আধিকারিকেরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কল্যাণী যেতে হয় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে।
শিক্ষামন্ত্রী এবং খোদ মুখ্যমন্ত্রীও কল্যাণীর ঘটনার নিন্দা করেছেন। কিন্তু এর আগে নানা সময়ে এ ধরনের ঘটনায় তাণ্ডবকারীদের পাশেই দাঁড়িয়েছে সরকার। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনায় তাঁর দলেরই নেতারা জড়িয়ে পড়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রী তাকে ‘ছোট ঘটনা’ বলে অভিহিত করেন। পার্থবাবুকেও বলতে শোনা গিয়েছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে রাজ্যই অর্থ দেয়। তাই প্রয়োজনে সেখানে সরকার হস্তক্ষেপ করতেই পারে।
কিন্তু শিক্ষাবিদদের মতে, সরকারের ভূমিকা ওইটুকুই। বিশেষত উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের আর কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ার প্রফেসর স্বপন চক্রবর্তীর কথায়, “শিক্ষা বিতরণের পরিকাঠামো নির্মাণ করাই সরকারের কাজ। এর বাইরে তার কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না।” প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ও বলেছেন, “আর্থিক নিয়ন্ত্রণের পথ ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে সরকার। এটা একেবারেই অনভিপ্রেত। সরকারি হস্তক্ষেপ হলে কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যথাযথ উন্নতি হতে পারে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy