তাঁর প্রার্থী হওয়া আটকাতে এক দিন আলিপুরের রাস্তায় গলায় শাল জড়িয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। এখন সেই শঙ্কর সিংহকে হাতিয়ার করেই বিরুদ্ধ শিবিরের দুই জোড়া ফলা মুকুল রায় এবং অধীর চৌধুরীকে ভোঁতা করার পরিকল্পনা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
রাজ্যে কোণঠাসা কংগ্রেস এখনও মুর্শিদাবাদ এবং মালদহে ‘সাইনবোর্ড’ হয়নি। মুর্শিদাবাদ অধীরের খাস তালুক। সেই তালুকের দখল নিতে মমতা একদা তাঁর সেনাপতি মুকুলকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অধীর-দুর্গে আঘাত করতে মুকুল রেজিনগরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীরকে কংগ্রেস থেকে ভাঙিয়েছিলেন। কিন্তু আঘাত হানা দূরে থাকুক, হুমায়ুনকে নিয়ে মুর্শিদাবাদে তৃণমূলেই হুলুস্থূল কাণ্ড হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হুমায়ুনকেই তৃণমূল থেকে বহিষ্কার করতে হয়েছে। এখন আবার মুকুল-হুমায়ুন ঘনিষ্ঠতা মুর্শিদাবাদে তৃণমূল নেতৃত্বের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে! আর অধীর-কাঁটা
তো আছেই। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মমতা নদিয়ার শঙ্করকেই হাতিয়ার করতে চলেছেন বলে তৃণমূলের অন্দরের খবর।
কংগ্রেস ছেড়ে শঙ্করের তৃণমূলে যোগদান এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তৃণমূল শিবিরের খবর, নদিয়ার পাশের জেলা মুর্শিদবাদেও তৃণমূলের দেখভালের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব শঙ্করকে দিতে পারেন মমতা। কারণ, শঙ্করের হাত ধরেই অধীরের কংগ্রেসে প্রবেশ ঘটেছিল। একটা সময়ে শঙ্কর-অধীরের যৌথ নেতৃত্বে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট বেড়েছিল। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “অধীরের নাড়িনক্ষত্র যেমন শঙ্করদা জানেন, তেমনই মুর্শিদাবাদ জেলাটাও চেনেন। আর বিধানসভা ভোটের আগে অধীর-গড় দখল করতে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি অরাজনৈতিক লড়াইও দরকার।”
অরাজনৈতিক লড়াইয়ের বিষয়টা ওই নেতা খোলসা করেননি। তবে জেলার কংগ্রেস ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকেরই বক্তব্য, জেলায় ঠিকাদারি কাজ ঘিরে রাজনীতি অনেকটাই অধীরের নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হয়। সেখানে জেলার বাইরে থেকে আসা কোনও নেতার পক্ষে দাঁত ফোটানো মুশকিল। কিন্তু শঙ্কর নিজগুণে সেই রাজনীতির অনেক কূট-কৌশলই জানেন। একদা তিনি চুটিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসাও করেছেন। ফলে, মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের সংগঠনকে মজবুত করতে শুভেন্দু অধিকারী বা ইন্দ্রনীল সেনকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দিলেও শঙ্করকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে চান মমতা। তার উপরে তৃণমূল জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের সঙ্গেও শঙ্করের সম্পর্ক ভাল। অধীরের ‘অবহেলা ও অপমানে’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মান্নানও কংগ্রেস ছেড়েছিলেন। শঙ্করও সেই পথের পথিক হচ্ছেন। ফলে, মান্নান-শঙ্কর রসায়নও কাজে লাগাতে চান মমতা।
একদা নদিয়ায় রানাঘাটের পার্থ (বাবু) চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তাহেরপুর, বীরনগরের শঙ্কর-অনুগামী বেশ কয়েক জন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। লোকসভা ভোটের আগে শান্তিপুরের বিধায়ক অজয় দে-ও তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় জেলায় কংগ্রেসের অবস্থা এখন সঙ্গিন। নদিয়ায় এ বার রানাঘাট, শান্তিপুর, তাহেরপুর, তেহট্ট, বীরনগর, নবদ্বীপ, কল্যাণী এবং হরিণঘাটা মিলে মোট ৮টি পুরসভার ভোট আসন্ন। কল্যাণী, হরিণঘাটায় মুকুল ও তাঁর বিধায়ক-পুত্র শুভ্রাংশুর অনুগামীদের নিয়ে চিন্তিত তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু এখনও এই সমস্ত এলাকায় শঙ্করের অনুগামীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ‘মুকুল-ফলা’কে ঘায়েল করতে শঙ্করকে ব্যবহার করা হবে বলে তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য।
নদিয়ার ৮টি এবং মুর্শিদাবাদের ৬টি পুরসভার ভোটের দলীয় প্রার্থী তালিকা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শঙ্করের যোগদানের পরে তা ঘোষণা করার নির্দেশ তৃণমূল নেত্রী দিয়েছেন বলেই রানাঘাটের শঙ্কর-ঘনিষ্ঠদের দাবি। তাঁদের ব্যাখ্যায়, পুর-প্রার্থী তালিকায় শঙ্কর-ঘনিষ্ঠ দু-এক জনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা মাথায় রেখেই তালিকা ঘোষণায় বিলম্ব করা হচ্ছে। যদিও নদিয়ার ১৪ জন তৃণমূল বিধায়কের অনেকেরই বক্তব্য, ব্যাপারটা আসলে তা নয়। তাহেরপুরে সীমানা পুনর্বিন্যাসে একটি ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমস্যা থাকায় ৮টি পুরসভার প্রার্থী ঘোষণাই আপাতত একটু পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুর্শিদাবাদে যে সব পুরসভায় ভোট, তার মধ্যে বেলডাঙ্গা, কান্দি এবং লালবাগ আছে কংগ্রেসের হাতে। বামেদের দখলে আছে জঙ্গিপুর এবং জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ। ধুলিয়ানে অবশ্য ‘দলবদলুদে’র দাক্ষিণ্যে এখন ক্ষমতায় তৃণমূল। তাদের লক্ষ্য, পুরভোটে মুর্শিদাবাদে নিজেদের জমির আরও বিস্তার ঘটানো। এই লক্ষ্যেই অধীর-দুর্গে ফাটল ধরাতে শঙ্করকে কাজে লাগাতে চান তৃণমূল নেতৃত্ব। তবে কংগ্রেস নেতা ও বহরমপুরের বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীর তির্যক মন্তব্য, “পিসির গোঁফ গজিয়ে বাবারা যেমন পাঁচ ভাই হবেন না, তেমনই মুর্শিদাবাদেও তৃণমূলের বিজয় পতাকা উড়বে না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy