Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

মাথা বাদে বাকি অঙ্গ অসাড়, মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি

পাঁচ বাই সাতের ছোট্ট ঘরের বিছানাটাই এখন তাঁর কাছে পুরো পৃথিবী। মাথাটা কাজ করে ঠিকঠাক। কিন্তু শরীরের বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসাড়। জায়গায় জায়গায় পচন ধরছে। চিকিৎসা করানোর টাকা নেই।

প্রায় দশ বছর এ ভাবেই বিছানায় শুয়ে ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জীব বর্ধন। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

প্রায় দশ বছর এ ভাবেই বিছানায় শুয়ে ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জীব বর্ধন। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

বিতান ভট্টাচার্য
ব্যারাকপুর শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৫
Share: Save:

পাঁচ বাই সাতের ছোট্ট ঘরের বিছানাটাই এখন তাঁর কাছে পুরো পৃথিবী।

মাথাটা কাজ করে ঠিকঠাক। কিন্তু শরীরের বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসাড়। জায়গায় জায়গায় পচন ধরছে। চিকিৎসা করানোর টাকা নেই। এ ভাবে আর বাঁচতে চান না ইছাপুরের সঞ্জীব বর্ধন। মুক্তি চান, জীবনের কাছ থেকে।

নিজের হাতটুকু ঠিকমতো নাড়ার ক্ষমতা নেই। কাঁপা কাঁপা অক্ষরে চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ২৮ নভেম্বর চিঠি পোস্ট করা হয়েছে। এখনও উত্তর মেলেনি। ওই চিঠিতে সঞ্জীব আর্জি জানিয়েছেন, তাঁকে স্বেচ্ছামৃত্যুর সুযোগ দেওয়া হোক। বৃদ্ধ বাবা-মা ছেলের সেই ইচ্ছাকেই মর্যাদা দিতে চেয়েছেন।

সঞ্জীব মুখ্যমন্ত্রীকে লিখেছেন, ‘‘ঈশ্বর আমার বাঁচার সব ক’টি কারণই অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। শারীরিক ভাবে কখনও আর সুস্থ হতে পারব না। মানসিক জোরটাও হারিয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর অপেক্ষায় কাটছে প্রতিটা দিন। কিন্তু আমার প্রতি দিন বাঁচাটা মৃত্যুর থেকে কম কিছু নয়।’’

কী ভাবে এই হাল হল সঞ্জীবের?

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দিব্যি চাকরি করছিলেন। সেই সূত্রেই থাকতেন অসমের গুয়াহাটিতে।

২০০৬ সালে তেজপুরের কাছে হাইওয়েতে মোটরবাইক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। প্রাণে বাঁচলেও শিরদাঁড়া সোজা করে আর দাঁড়াতে পারেননি। কলকাতা থেকে ভেলোর— অসংখ্য জায়গায় একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। কিন্তু সুস্থ হননি। খাওয়া-দাওয়া তো বটেই, প্রাতঃকৃত্যের কাজটুকু সারতেও ভরসা করতে হয় অন্যের উপরে।

ইছাপুরের নতুন পাড়ায় সঞ্জীবদের একতলা ছোট্ট বাড়ি। বাবা তপনবাবুর চালের দোকান আছে ইছাপুর বাজারে। যা আয় হয়, তাতে তিনজনের সংসার চালাতে হিমসিম খান বৃদ্ধ। এই অবস্থায় ছেলের চিকিৎসার খরচ আর টানতে পারছেন না তিনিও। বৃদ্ধের কথায়, ‘‘একাধিকবার ভেবেছি, সকলে মিলে আত্মহত্যা করি। আমাদের দু’জনের একজন না থাকলে তো ছেলেটা এমনিই মারা যাবে। সুস্থ করার উপায় নেই। আর চোখের সামনে ওর ফুরিয়ে যাওয়াটা আর সহ্য করতে পারছি না।’’ ছেলের কষ্ট দেখে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছু করার নেই মা বীথিকাদেবীর। নিজেরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আয়া রাখার সামর্থ্য নেই। অসুস্থ শরীরে কোনও মতে ছেলের পরিচর্যা করেন।

সঞ্জীব ইছাপুর নর্থল্যান্ড হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। তাঁর কিছু সহপাঠী সম্প্রতি তাঁর নামে সোস্যাল মিডিয়ায় একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। কিন্তু সেখান থেকেও বিশেষ আর্থিক সাহায্য মেলেনি বলে জানালেন প্রদীপ বসু নামে এক বন্ধু।

২০১১ সালে অরুণা শানবাগ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর (প্যাসিভ ইউথেনশিয়া) অধিকার দেয়। যার অর্থ, ‘লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম’ বা ভেন্টিলেশনে থাকা অবস্থায় যন্ত্রপাতি খুলে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সরাসরি স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার (যেমন, ইঞ্জেকশন দিয়ে মৃত্যুর ব্যবস্থা) এখনও এ দেশে আইনি স্বীকৃতি পায়নি। এ সব অজানা নয় সঞ্জীবের। তবু মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হলে যদি কিছু সুরাহা হয়, সেই আশাতেই চিঠি লিখেছেন।

বিছানায় শুয়ে বললেন, ‘‘বাবা-মাকে ছাড়া আমি নিজে কিছু কাজ করতে পারি না। এ ভাবে বেঁচে থাকাটা ভয়ঙ্কর। দশটা বছর তবু কেটেই গেল। আর পারছি না। এই জীবনের থেকে মৃত্যু শ্রেয়।’’

অন্য বিষয়গুলি:

euthanasia Youth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE