(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপ ঘোষ (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
সোমবার বিকাল পর্যন্ত আরজি কর-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নমনীয় ভূমিকা’ নিয়ে আশ্বস্ত ছিলেন আন্দোলনকারীরা। আশ্বস্ত ছিল শাসক তৃণমূলও। কিন্তু সোমবার বিকালের পরেই আরজি করের পদত্যাগী অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করার নির্দেশের পর বিষয়টি ঘুরে গিয়েছে। ‘উদ্বেগ’ তৈরি হয়েছে শাসক শিবিরে। ‘অসন্তোষ’ তৈরি হয়েছে আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের মধ্যে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসক এবং রাজনীতিক মমতা কি তাঁর জনতার ‘নাড়ি’ বোঝার ক্ষমতা ঠিকঠাক প্রয়োগ করেছেন?
শাসক শিবিরের এক শীর্ষনেতার মতে, ওই সিদ্ধান্ত (সন্দীপকে অন্য কলেজে বদলি করা) এক সপ্তাহ বা ১০ দিন পরেও নেওয়া যেত। তত দিনে পরিস্থিতি খানিকটা থিতিয়ে যেতে পারত। তা না করে তড়িঘড়়ি বেলা গড়ানোর আগেই সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরিস্থিতি খানিকটা ‘প্রতিকূল’ হয়ে পড়েছে। সোমবার রাতেই তৃণমূলের এক নেতা বলছিলেন, ‘‘ওই নির্দেশের কথা জানার পরে আমরা নিজেরাই আলোচনা করছিলাম যে, এটা এখন না করলেও চলত। ওঁর বিরুদ্ধে যে পরিমাণ ক্ষোভের আগুন জমা হয়েছে, এই সিদ্ধান্তে তাতে আরও ঘি পড়তে পারে।’’
তা যে হয়েছে, তা সোমবার রাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাতেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন সেখানকার আন্দোলনকারীরা। ঘরের দরজায় পোস্টার পড়েছে। ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে কাকতাড়ুয়া। চিকিৎসকেরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে আলোচনা সাপেক্ষে মঙ্গলবার সকাল থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যালে ‘ব্যারিকেড’ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন। যা শুরুও হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সন্দীপ কাজে যোগ দিতে গেলে কী হবে, তা নিয়েই শঙ্কিত শাসক শিবিরের লোকজন। অনেকেই একান্ত আলোচনায় জানাচ্ছেন, এই পরিস্থিতিতে সন্দীপের লম্বা ছুটিতে চলে যাওয়া উচিত। পরিস্থিতি শান্ত হলে কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না হয়।
অথচ সন্দীপের ‘পুনর্বাসন’-এর নির্দেশের আগে পর্যন্ত প্রশাসক এবং রাজনীতিক মমতা ঘটনার রাশ পুরোপুরিই নিজের হাতে রেখেছিলেন। শুরু থেকেই তিনি ‘নমনীয়’ ছিলেন। প্রশাসক হিসেবে যা যা করণীয়, সেটাই করেছেন। সোমবার সকালে সন্দীপের আরজি করের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেওয়া পর্যন্ত ঘটনা এতটা ‘প্রতিকূল’ জায়গায় যায়নি।
তৃণমূল জমানার গত ১৩ বছরে রাজ্য ধর্ষণ-খুনের ঘটনার নজির রয়েছে। মমতার শাসনকালকে আক্রমণ করতে বিরোধীরাও একনিঃশ্বাসে উচ্চারণ করে পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, গেদে, গাইঘাটা, মধ্যমগ্রাম বা হাঁসখালির নাম। একাধিক ঘটনায় তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্য তো বটেই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, ধর্ষিতা বা নিগৃহীতার প্রতি যে ‘সংবেদনশীলতা’ দেখানো উচিত, অপরাধীদের বিরুদ্ধে যে কঠোর মনোভাব দেখানো উচিত, তা রাজ্য প্রশাসনের তরফে দেখানো হয়নি। কিন্তু আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় গত পাঁচ দিন ধরে যখন রাজ্য তোলপাড়, তখন রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহল মনে করেছে, মুখ্যমন্ত্রী ‘নমনীয়’ অবস্থান নিয়েছে। অতীতের ঘটনা টেনে অনেকেই বলছিলেন, মমতার এই অবস্থান ‘ব্যতিক্রমী’। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজের মুখে সিবিআই তদন্তের কথা বলেছেন। ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে কথা বলা, পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া, শেষে সোমবার মেয়েটির বাড়িতেও পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর থেকেই স্পষ্ট, আরজি কর-কাণ্ড এক বিরল ঘটনা।’’
প্রসঙ্গত, কামদুনির ঘটনার পরেও মমতা সেখানে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু গ্রামের দুই ‘প্রতিবাদী’ মৌসুমি কয়াল এবং টুম্পা কয়ালের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তাঁদের উদ্দেশে ‘সিপিএম’ এবং ‘মাওবাদী’ বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তা নিয়ে কম হইচই হয়নি। পরে দেখা গিয়েছিল মৌসুমি-টুম্পারা ‘প্রতিবাদের মুখ’ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু গত চার দিনে বিরোধীরাও মমতার মন্তব্যকে ‘হাতিয়ার’ করে কোনও সমালোচনা করতে পারছিলেন না।
ঘটনাটি যে দিন ঘটে, সেদিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ঝাড়গ্রামে। সেখান থেকেই তিনি কথা বলেন মৃতার বাবার সঙ্গে। ফেরার পথে একাধিক বার ফোন করেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। পুলিশ সূত্রের খবর, কমিশনারকে মুখ্যমন্ত্রী বারংবার নির্দেশ দেন, ওই ঘটনায় যেন নজিরবিহীন দ্রুততায় তদন্ত শুরু করে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়। তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নিয়ে লাগাতার খোঁজখবর রাখতে শুরু করেন। তদন্তের প্রতিটি ধাপ যাতে তাঁকে জানানো হয়, সেই মর্মেও নির্দেশ দেন। তিনি তখনই প্রশাসনিক মহলে জানিয়েছিলেন যে, যথাসম্ভব দ্রুত তিনি নিহত চিকিৎসকের বাড়িতে যাবেন।
শনিবার মুখ্যমন্ত্রী জানান, তাঁদের সরকারের উপর আস্থা না-থাকলে মৃতার পরিবারের লোকজন অন্য যে কোনও তদন্তকারী এজেন্সির কাছে যেতে পারেন। যেতে পারেন সিবিআইয়ের কাছেও। মমতা বলেন, ‘‘তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’’ প্রসঙ্গত, তাঁর সরকারের উপর ‘আস্থা’ না থাকার প্রসঙ্গ মমতা গত ১৩ বছরের শাসনকালে কখনও বলেননি। এই প্রথম। সেই সূত্রেই শাসক শিবিরের লোকজন মনে করেছিলেন, এই ঘটনায় মমতা অনেক ‘নমনীয়’ অবস্থান নিয়েছিলেন।
তার কারণ নিয়েও শাসক শিবিরের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছিল। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘এর আগে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটলেও তার সঙ্গে ডাক্তার এবং পুলিশ জুড়ে যায়নি। এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন এক ডাক্তার। মূল অভিযুক্ত হিসেবে যাঁকে ধরা হয়েছে, তিনি সিভিক ভলান্টিয়ার। ঘটনাচক্রে, এই দু’টি দফতরই রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে।’’ তৃণমূলের অনেকে এ-ও বলছেন যে, বিষয়টি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। মুখ্যমন্ত্রী ‘নমনীয়’ মনোভাব না দেখালে আগুনে ঘি পড়ত। ওই ঘটনার পর থেকে রাজ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ‘কড়া’ হলে সেই পরিষেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছিল। তা হলে রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একটি ‘অরাজক’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত।
শাসকদলের নেতারা ঘরের পাশের বাংলাদেশের প্রসঙ্গও টানছেন। তাঁদের বক্তব্য, শাসকের মন্তব্য কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশ তার উদাহরণ। একই সঙ্গে বাংলাদেশ দেখিয়েছে, তরুণ প্রজন্ম, ছাত্রসমাজ এবং নাগরিক সমাজের আন্দোলন কোন স্তরে পৌঁছতে পারে এবং তার অভিঘাত কী হতে পারে। তৃণমূলের এক নেতা সোমবার বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তাতে সাত মাস আগে আওয়মী লীগের ভোটে জেতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে। পুঞ্জীভূত গণক্ষোভ রাজপথে আছড়ে পড়েছে। আমরা ভোটে জিতলেও এ কথা বাস্তব যে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা রয়েছে। গোটা ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাতে সরকার এবং দলের সংবেদনশীলতা বোঝানো গিয়েছে।’’
তৃতীয় একটি বিষয়ও তৃণমূলের আলোচনায় রয়েছে। লোকসভা ভোটের পরবর্তী সময়ে মমতার ভূমিকার ধারাবাহিকতা। ফুটপাথে ‘বেআইনি’ দখলদার উচ্ছেদে বুলডোজ়ার নামায় জনমানসের একাংশে যখন ‘নেতিবাচক’ ধারনা তৈরি হচ্ছিল, তখন মমতাই তা থামিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কোনও মানুষকে বেকার করার অধিকার আমাদের নেই।’’ সেই সূত্রেই শাসক শিবিরের একাংশ বলছেন, লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী পর্ব থেকে দেখা যাচ্ছে, মমতা নিজে শাসকের পাশাপাশি ‘বিরোধী নেত্রীর’ ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছেন। উত্তরবঙ্গে দলের নেতাকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। যেমন গ্রেফতার করা হয়েছে ভাঙড়ে তৃণমূলের ‘দাপুটে নেতা’ আরাবুল ইসলামকে।
অতীতে রাজ্যের অনেক ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি উঠেছে। কিন্তু নবান্ন তা পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু আরজি করের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাঁদের ক্ষোভ সঙ্গত।’’ তখনই তিনি বলেছিলেন, রাজ্য সরকারের উপর আস্থা না-থাকলে অন্য কোনও এজেন্সি তদন্ত করলেও তাতে নবান্নের আপত্তি নেই। সোমবার নিহত চিকিৎসকের সোদপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতা পুলিশকে রবিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা। বলেছেন, ‘‘রবিবারের মধ্যে কলকাতা পুলিশ কুলকিনারা করতে না পারলে আমরা সিবিআইকে (তদন্তের দায়িত্ব) দিয়ে দেব।’’ তবে পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তাপসী মালিকের ধর্ষণ-খুন, রিজওয়ানুর রহমানের হত্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরির ঘটনার তদন্ত সিবিআই এখনও শেষ করতে পারেনি। তবে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘সন্তুষ্টি’র উপর বার বার জোর দিতে চেয়েছেন তিনি।
রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, সেই কারণেই ঘটনার পরে চার দিন কেটে যাওয়ার পরেও বিরোধীরা সে ভাবে ‘ময়দানে’ নামতে পারেনি। যা হয়েছে সবই তাৎক্ষণিক এবং বিক্ষিপ্ত। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আদালতে গিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতির মাঠে নেমে তারা আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি। আন্দোলন যা হচ্ছে, তা হয় নাগরিক সমাজের, নয় পড়ুয়াদের। তবে সেই পড়ুয়াদেরই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, কেন মুখ্যমন্ত্রী আগামী রবিবার পর্যন্ত সময় নিলেন? কেন এখনই বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিলেন না? যে দাবি পড়ুয়াদের ‘মূল’ চাহিদা।
কিন্তু তড়িঘড়ি সন্দীপকে আবার একটি সরকারি মেডিক্যান কলেজের অধ্যক্ষ পরে বহাল করাকে অনেকেই মমতার গত পাঁচ দিনের ভূমিকার সঙ্গে মেলাতে পারছেন না। তাঁরা মনে করছেন, এই একটি সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি ‘ঘোরালো’ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy