অপেক্ষা: হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের লম্বা লাইন। বুধবার, এসএসকেএমে। নিজস্ব চিত্র।
এসএসকেএমের কার্ডিয়োলজি বিল্ডিংয়ের উল্টো দিকে বাঁধানো বসার জায়গায় বুকে যন্ত্রণা নিয়ে তখন শুয়ে বছর ষাটের প্রৌঢ়া। পরিজনেরা জানালেন, একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছে। খেয়ে যন্ত্রণা না কমলে ইসিজি এবং রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছেন চিকিৎসক। তখন দেখা হবে রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না।
যে রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না দেখা হবে, তাঁকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কার্ডিয়োলজি বিল্ডিংয়ের বাইরে? আলিপুরের বাসিন্দা ওই প্রৌঢ়ার সঙ্গে আসা প্রতিবেশী যুবকের কথায়, ‘‘চিকিৎসকেরা দেখছেন। কিন্তু আমরা তো ভিআইপি নই। তাই বাইরে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায়ও নেই।’’
বুধবার বিকেল সাড়ে চারটে। কার্ডিয়োলজির বহির্বিভাগের পাশের ঘেরা চত্বর ভিড়ে ঠাসা। কেন? কারণ সেখানে কাউন্টার থেকে রক্ত-সহ অন্যান্য পরীক্ষার দিন ও সময় দেওয়া হচ্ছে। লাইনে দাঁড়ানো পরিজনের ফেরার অপেক্ষায় থাকা অনেক রোগীই কাউন্টারের সামনের কংক্রিটের মেঝেতে শুয়ে পড়েছেন। কানে এল খেদোক্তি, ‘‘উডবার্ন ওয়ার্ডে যখন-তখন উপরমহলের লোকজন ভর্তি হন। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে সব পরীক্ষাও হয়ে যায়। আমাদের সেই সুযোগ নেই।’’ কিছু দূরে পিজি-র উডবার্ন ওয়ার্ডে তখন বার বার ঢুকছেন-বেরোচ্ছেন বরিষ্ঠ চিকিৎসকেরা। জানা গেল, অনুব্রত মণ্ডলের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ডাক্তারদেরই ওই ব্যস্ততা। এ দিন সকালেই এসএসকেএমে আসেন অনুব্রত। তখন থেকেই শাসকদলের ‘ভিআইপি’ নেতার জন্য উডবার্ন ব্লকের সামনে মোতায়েন হয়েছে পুলিশ। ঘেরা হয়েছে রাস্তা। এর জেরে ওই ব্লকে ভর্তি রোগীদের পরিজনেরাও সমস্যায় পড়েন। কড়া বেষ্টনী পেরিয়ে ঢুকতে-বেরোতে নাকাল হতে হয়েছে তাঁদের।
সাম্প্রতিক তথ্য দেখলে প্রশ্ন ওঠে, এই ‘অনিয়মের’ সঙ্গে অনেকটাই কি অভ্যস্ত হচ্ছে এসএসকেএম? বিধানসভা ভোটের পরে নারদ মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়ার রাতেই বুকে ব্যথা ও অস্বস্তির মতো সমস্যা নিয়ে উডবার্ন ব্লকে ভর্তি হন মদন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়েরা। সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে আগেও দীর্ঘ দিন উডবার্ন ব্লকে কাটিয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী মদন। কয়লা পাচার-কাণ্ডে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার বিকাশ মিশ্রও দীর্ঘ দিন সেখানে ভর্তি ছিলেন। কয়েক বছর আগে ভাঙড়ের আরাবুল ইসলাম পিজি-র কার্ডিয়োলজির আইসিইউ-তে দীর্ঘ দিন কাটিয়েছিলেন। সেই তালিকায় জুড়ল তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের নাম। গরু পাচার মামলায় এ দিন তাঁর নিজ়াম প্যালেসে সিবিআইয়ের আঞ্চলিক দফতরে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল।
অবশ্য তিনি আদৌ সেখানে হাজির হবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিলই রাজনৈতিক মহলের। মঙ্গলবার যখন অনুব্রত বোলপুর থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন, তখনই সাধারণ মানুষের একাংশের জল্পনা ছিল, এ বারের গন্তব্য কি এসএসকেএম? সব সংশয়কে সত্যি করে এ দিন সকালে পিজি-র উডবার্ন ব্লকে ঢুকে যান অনুব্রত। শারীরিক পরীক্ষায় তাঁর হার্ট অ্যাটাকের প্রমাণ মেলেনি। তবে উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য পুরনো রোগের সমস্যা রয়েছে। শ্বাসকষ্টের জন্য অক্সিজেনও দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
উডবার্নে আত্মীয়কে দেখতে এসে দিনভর নাস্তানাবুদ এক যুবকের ক্ষোভ, ‘‘অভিযুক্ত নেতা-মন্ত্রীদের কাছে উডবার্ন ব্লক তো আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু হলেই বুকে চাপ অনুভব করে সোজা ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা!’’ অন্য এক রোগীর আত্মীয়ের বক্তব্য, ‘‘আমরা হলে তো ওষুধ লিখে বাড়ি ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু ‘ভিআইপিদের’ ব্যাপার তো আলাদা হবেই! না হলে প্রশাসনের কোপে পড়বেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’’ অভিযোগ যে অমূলক নয়, জানাচ্ছেন চিকিৎসকদের একাংশও। কোনও মামলার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার মুখোমুখি কিংবা গ্রেফতারের মতো পরিস্থিতি এড়াতে অসুস্থ হয়ে যান অভিযুক্তেরা। এর পরেই তাঁদের এসএসকেএমে ভর্তি হওয়ার পদ্ধতিটি অলিখিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের অনেকেই।
‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ এসএসকেএম, এমন তকমা খোঁচা দিচ্ছে চিকিৎসকদের একাংশের অন্দরেও। তাঁদের দাবি, ‘‘এমন আশ্রয়স্থল হতে থাকলে অচিরেই উডবার্ন গরিমা হারাবে।’’ মামলায় অভিযুক্ত উপরমহলের রোগী ভর্তি হলে তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বও বড় মাথাব্যথা বলে জানাচ্ছেন সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে নেতা-মন্ত্রী, আমলারা ভর্তি হলে আমাদের আপত্তি নেই। বরং তাতে সরকারি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। কিন্তু তাঁদের ভর্তি হওয়ার সময়টাই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।’’
অবশ্য এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘‘যে কেউ অসুস্থতা নিয়ে এলে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়াই আমাদের কর্তব্য।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy