সরকার ধর্ম-নিরপেক্ষ। আদালতের কাছে তার জমা দেওয়া হলফনামাও তা হলে ধর্ম-নিরপেক্ষই হওয়া উচিত। ধর্মীয় বিভেদ যেখানে সারা দেশেই এক অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে এমনই সওয়াল করছেন অনেকে।
তাঁদের বক্তব্য, ব্যক্তিগত হলফনামায় কেউ নিজের ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করতেই পারেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আধিকারিক, যিনি ওই সরকারি হলফনামায় সই করেছেন, তাঁর ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করা থেকে কি বিরত থাকা যায় না? সরকারি হলফনামা যদি ধর্ম-নিরপেক্ষ হয়, তা হলে একটি ইতিবাচক বার্তাই যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা। বিশেষ করে পোশাক দেখে, খাদ্যাভ্যাস দেখে যেখানে মানুষকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে!
পরিবেশ সংক্রান্ত একটি মামলায় গত মাসে জাতীয় পরিবেশ আদালতে নিজেদের হলফনামা জমা দিয়েছিল রাজ্য পূর্ত দফতর ও কলকাতা পুরসভা। দু’টি হলফনামার ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট আধিকারিক, যাঁরা সই করেছেন, তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় লেখা ছিল। মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র বলছেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট অফিসার যিনি সই করছেন, তিনি তো ব্যক্তিগত ভাবে ওই হলফনামা জমা দিচ্ছেন না, তিনি সরকারের প্রতিনিধি। সরকারের তো ধর্মীয় পরিচয় নেই। তবে তাঁর ক্ষেত্রেই বা কেন ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করা হবে?’’
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘বর্তমানে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার ক্ষেত্রে বাবার পরিচয়ের প্রয়োজন হচ্ছে না। মায়ের পরিচয়েই ভর্তি করা যাচ্ছে। অনেক জায়গায় পদবির উল্লেখ করাও বাধ্যতামূলক নয়। সেখানে ধর্মীয় পরিচয়, বিশেষত সরকারি হলফনামায় না রাখলে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে নিঃসন্দেহে।’’
হলফনামায় ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করা কি বাধ্যতামূলক?
একদমই নয়। জানাচ্ছেন আইন-বিশেষজ্ঞেরা। নিজের নাম, বাবার নাম, কোথায় থাকেন বা কোথায় কাজ করেন সেটা উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করাটা নিতান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা ইলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শ্যামল সেন বলছেন, ‘‘কেউ ইচ্ছে করলে হলফনামায় ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পারেন। আবার না-ও পারেন।’’ আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের বক্তব্য, অনেক সময়ে সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে ধর্মের পরিচয় দরকার হয়। কারণ যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে, তা হিন্দু, মুসলিম না খ্রিস্টান আইনে হবে, সে জন্য। অরুণাভবাবু বলছেন, ‘‘কিন্তু সেখানেও ধর্মীয় পরিচয় হলফনামায় দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়।’’ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব সমর ঘোষও বলছেন, ‘‘হলফনামায় ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করার ক্ষেত্রে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বাধাও নেই।’’
তবুও সেটা উল্লেখ করা হয়। কারণ, সেই মুঘল আমল থেকেই এ রকম হচ্ছে। সেই রীতি যে যথেষ্ট পুরনো, তা হলফনামা শব্দটির উৎপত্তিই বলছে। ভাষাবিদেরা জানাচ্ছেন, হলফনামায় ‘হলফ’ শব্দটি হল আরবি ও ‘নামা’ শব্দটি হল ফারসি। ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘আরবি, ফারসি শব্দগুলি কয়েকশো বছর আগেই এ দেশে এসেছে। ফলে এটি অনেক পুরনো শব্দ। হলফনামা শব্দটির অর্থ হল শপথ-লিপি।’’ প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় আবার বলছেন, ‘‘আসলে হলফনামা জমা দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। সেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের একটি জায়গা রয়েছে। ব্রিটিশ বা তার আগের আমলের সেই রীতি এখনও চলে আসছে।’’
রাজ্য প্রশাসনের পদস্থ কর্তাদের একটি অংশ অবশ্য বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি হলফনামায় ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করা হয় না। ‘‘পরিবেশ সংক্রান্ত একটি মামলায় যেখানে মুখ্যসচিব নিজে হলফনামায় সই করেছিলেন, সেখানে কিন্তু তিনি কোনও ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করেননি। শুধু নিজের নাম, বাবার নাম, বয়স, সরকারে তাঁর পদ এবং তিনি যেখানে কর্মরত, সেই নবান্নের ঠিকানা উল্লেখ করেছিলেন।’’ বলছেন রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা।
কিন্তু ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ না করাটা ব্যতিক্রম নয়, বরং অলিখিত নিয়ম হোক সরকারের। ধর্মীয় বিভাজনের পরিস্থিতিতে এমনটাই চাইছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy