Advertisement
১৯ অক্টোবর ২০২৪
Narayan Banerjee CPM

ভোটের ভান্ডারে লক্ষ্মী নেই! তাই নারায়ণ-শ্রীলেখাদেরই আপাতত খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরছে সিপিএম

চিকিৎসক নারায়ণ জানিয়েছেন, তিনি অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের কথা ভেবে ‘আন্তরিক’ ভাবেই কুণালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তামাম সিপিএম তা ‘অভিসন্ধি’ হিসাবে অভিহিত করতে চেয়েছে।

(বাঁ দিকে)  চিকিৎসক নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র (ডান দিকে)।

(বাঁ দিকে) চিকিৎসক নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র (ডান দিকে)।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৩৪
Share: Save:

বুধবারেও তিনি ছিলেন ‘কমরেড’। ছিলেন ‘নেতা’। ছিলেন ‘আমাদের লোক’। কিন্তু বৃহস্পতিবার এক ঘণ্টার একটি বৈঠকের পরের ছবি প্রকাশ্যে আসতেই পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। ‘কমরেড’ হয়ে গিয়েছেন ‘চটিচাটা’। ‘আমাদের লোক’ হয়ে উঠেছেন ‘কুণাল ঘোষের চামচা’! যাঁকে নিয়ে এই আকস্মিক ‘বোধিজ্ঞান’ লাভ, তিনি চিকিৎসক নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি বামেদের যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে সম্বোধন করেন। যিনি গত লোকসভা নির্বাচনেও দমদমের সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর সঙ্গে চুটিয়ে প্রচার করেছেন। ‘সুজনসখা’ হয়ে জনগণের উদ্দেশে হাত নেড়েছেন হুডখোলা জিপে চড়ে।

নারায়ণ এবং তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বৈঠক ঘিরে চিকিৎসক মহল আলোড়িত। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্‌স বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, নারায়ণ যা করেছেন, তা তারা সমর্থন করছে না। কিন্তু সিপিএমের অবস্থা ‘শোচনীয়’। বামেদের যে বাহিনী নারায়ণকে ‘নেতা’ করেছিল, তারাই এখন রে-রে করে নেমে পড়েছে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। দায় ঝাড়তে গিয়ে সিপিএম বলেছে, নারায়ণ তাঁদের দলীয় কাঠামোর মধ্যে পড়েন না। কিন্তু সে কথায় যে চিঁড়ে ভিজছে না, তা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন দলের প্রথম সারির নেতারা। একইসঙ্গে দলের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, কেন কর্মী-সমর্থকদের একাংশ বার বার সমাজের বিভিন্ন অংশের ‘কৃতী’দের দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেখলেই তাঁদের ‘নেতা’ বা ‘নেত্রী’ বানিয়ে দিতে চাইছেন! যা হয়েছিল নারায়ণের ক্ষেত্রে, এর আগে তা-ই হয়েছিল অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্রের সঙ্গেও।

সিপিএম নেতা সুজনের কথায়, ‘‘শ্রীলেখা মিত্র বা নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের নিজেদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা দলের কেউ নন। ফলে তাঁরা সব কাজ আমাদের দলের অনুশাসন মেনে করবেন, এ কথা আমরা মনে করি না। সেই মনোভাব নিয়ে আমরা চলিও না।’’ পাশাপাশি সুজন এ-ও বলেছেন, কুণালের সঙ্গে নারায়ণের বৈঠক নিয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা ‘সঙ্গত’। আবার সিপিএমের তরুণ নেত্রী দীপ্সিতা ধর মনে করেন, কর্মীদের একাংশের সচেতন হওয়া উচিত। রাজনৈতিক চর্চারও যে ঘাটতি রয়েছে, তা-ও মনে করেন দীপ্সিতা। তাঁর কথায়, ‘‘সমাজমাধ্যমে ‘আইকন’ তৈরির প্রবণতা বেড়েছে। সেখানে আদর্শ মুখ্য বিষয় থাকছে না। কাকে কত দেখা যাচ্ছে, তার উপরেই সব নির্ভর করছে। এতে আমি সেলিব্রিটিদের দোষ দেখি না। তাঁরা কখনও আমাদের দলের অবস্থানকে সমর্থন করতে পারেন, কখনও না-ও করতে পারেন। এ বিষয়ে আমাদের কর্মীদের আরও সচেতনতার প্রয়োজন। সেই চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে।’’

বাম মহলের সমালোচনা প্রসঙ্গে নারায়ণ বলেছেন, ‘‘আমি জানি ওঁরা হতাশ হয়েছেন। তাই সমাজমাধ্যমে লিখছেন বা বলছেন। আমি এ-ও জানি যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ নারায়ণের দাবি, তিনি অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের কথা ভেবে ‘আন্তরিক’ ভাবেই কুণালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তামাম সিপিএম তাকে ‘অভিসন্ধি’ হিসাবে অভিহিত করতে চেয়েছে। যাঁরা নারায়ণকে কথায় কথায় ‘লাল সেলাম’ জানাতেন, তাঁরাও কটাক্ষ করছেন। এমনই এক যুবনেতার ফেসবুক পোস্টের নীচে বরাহনগরের এক যুবনেত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘ওই জন্য বলি, হরির লুটের বাতাসার মতো লাল সেলাম ছড়ানোটা বন্ধ করো’।

অভিনেত্রী শ্রীলেখার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমে তাঁকে ফেসবুকে ‘নেত্রী’ বানিয়ে দিয়েছিলেন সিপিএমের কেউ কেউ। আবার ‘কুকুরকাণ্ডে’ সিপিএমের এক যুবনেতার সমালোচনা করায় শ্রীলেখাকে তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। শ্রীলেখার অবশ্য বক্তব্য, ‘‘আমি কোনও দিন নেত্রী ছিলাম না। হতেও চাইনি। আমি সিপিএমের এক জন সমর্থক। সেই হিসাবে গিয়েছি। আবার আমি যখন পথকুকুরদের দত্তক নেওয়ার কথা বলেছিলাম, তখন সিপিএমের এক কর্মীকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। যাঁরা আমায় কমরেড বলেন, সেই সময়ে তাঁদেরও অনেকে আমায় ট্রোল করেছিলেন। সে বিষয়েও আমি সরব হয়েছি। সিপিএম বলে চুপ করে থাকিনি।’’ চলমান চিকিৎসক আন্দোলন প্রসঙ্গে শ্রীলেখা বলেন, ‘‘অনেকে আমার মতো অনেকের ছবি দিয়ে সমাজমাধ্যমে ‘মুখ’ হিসাবে তুলে ধরছিল। আমি মনে করি, আমরা কেউ নই। এই আন্দোলনে মানুষই সব। এবং সেই আন্দোলন রাজনৈতিক। আমি এ-ও মনে করি, এই আন্দোলনের যদি রাজনৈতিক মুখ থেকে থাকেন, সেই মুখ হলেন মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়েরা। কারণ, গত ৯ অগস্ট মিনাক্ষীরা যদি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নির্যাতিতার শববাহী গাড়ি আটকানোর চেষ্টা না করতেন, তা হলে আন্দোলন এই জায়গায় আসত না বলে আমি বিশ্বাস করি।’’

শ্রীলেখা-নারায়ণ এখনও সিপিএমের প্রতি তাঁদের আনুগত্যের কথাই বলতে চেয়েছেন। শ্রীলেখার বিষয়টি এখন থিতিয়ে গিয়েছে। আপাতত নারায়ণ বঙ্গ সিপিএমের কাছে ‘শ্রেণিশত্রু’ হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছেন। সিপিএমের এক তরুণ নেত্রীর কথায়, ‘‘গলদটা গোড়ায়। কেউ দলের বনিয়াদি পড়াশোনাটাই করে না। ফলে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে।’’

আবার অনেকের মতে, তৃণমূল বা বিজেপিতে অন্য জগতের মানুষের ‘আধিক্য’ রয়েছে। যাঁরা অনেকেই প্রথম সারির কৃতী। তা নিয়ে বাম মহলে ‘হতাশা’ রয়েছে বলেও তাঁদের মত। সেই হতাশা থেকেই ‘যাকে পাই, তাকেই নেতা বানাই’ গোছের মনোভাব তৈরি হচ্ছে কর্মীদের একাংশের মধ্যে। আশ্চর্য নয় যে, তৃণমূল নেতা কুণাল তাঁদের কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএমের অবস্থা এখন এমনই যে, প্রবীণেরাও ভোটে হারেন। নবীনেরাও হারেন। সেই ২০০৮ সাল থেকে বলে আসছে, ভুল সংশোধন করবে। প্রতি বার ভোটে হেরে এক কথা বলে। ১৬ বছর ধরে সেই ক্যাসেটই বাজিয়ে চলেছে। সিপিএমের কর্মীদের একটা অংশ কাউকে পেলেই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চায়। আর ভেসে যায়।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Narayan Banerjee Sreelekha Mitra CPIM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE