কোন অঙ্কে দাবি? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কি নিজে থেকেই পড়ে যাবে? না কি ৩৫৬ ধারা জারি করে সরকার ফেলে দেওয়া হবে? না কি জারি করা হবে ৩৫৫ ধারা? বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি তেমনই চান? না-চাইলে রাজ্যের প্রথম সারির নেতারা লাগাতার কেন এমন বলছেন? কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কি রাজ্য নেতৃত্বের ভাবনার সাযুজ্য রয়েছে? না কি সবটাই ‘কৌশল’?
‘নীতিগত’ ভাবেই বিজেপি কোনও নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার বিপক্ষে। কারণ, তাতে যে দলের সরকার ফেলা হবে, তারা ‘শহিদ’-এর মর্যাদা পেয়ে যাবে এবং তার ফয়দা তোলার অবকাশ পাবে পরের নির্বাচনে। বিশেষ প্রয়োজনে সরকার ফেলে দেওয়ার ধারা সংবিধানে দেওয়া থাকলেও ওই পদক্ষেপকে মূলত ‘অগণতান্ত্রিক’ বলেই মনে করা হয়। ফলে বিজেপি চাইবে না তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সুযোগ পেয়ে যান। আর সংবিধানের ৩৫৫ ধারা জারির জন্য রাজ্য সরকারকেই আবেদন করতে হয়। তবে রাজ্যপাল বা আদালতের তরফেও এমন সুপারিশ করা যায়।
জগদীপ ধনখড় রাজ্যপাল থাকার সময়েও বার বার ৩৫৫ ধারা জারির দাবি তুলেছে বিজেপি। ধনখড়ের জায়গায় রাজভবনে সিভি আনন্দ বোস আসার পরে রাজ্য বিজেপি ৩৫৫-র দাবি তোলে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে কয়েকটি জায়গায় অশান্তি হওয়ায়। তাদের দাবি ছিল, রাজ্যের দু’টি এলাকাকে ‘উপদ্রুত’ অঞ্চল ধরে নিয়ে ৩৫৫ ধারা জারির জন্য কেন্দ্রকে রাজ্যপাল চিঠি পাঠান। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তখন বলেছিলেন, ‘‘সাংবিধানিক প্রধান তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে রিপোর্ট না চেয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দিল্লিকে জানান। তা হলে বুঝব, উনি কিছু করে দেখাতে চাইছেন!’’
ঘটনাচক্রে, বছর খানেক আগে থেকে শুভেন্দু রাজ্য সরকারকে ‘নিষ্কর্মা’ (লেম ডাক) বলতে শুরু করেছেন। সোমবারও শুভেন্দু দাবি করেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি ৩৫৫ প্রয়োগের অনুকূল।’’ তবে পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, তিন ভাবে ওই ধারা প্রয়োগ করা যায়। প্রথমত, রাজ্য মন্ত্রিসভা কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে রাজ্যপাল যদি সুপারিশ করেন। সে ক্ষেত্রে মণিপুরে সিআরপিএফের অবসরপ্রাপ্ত ডিজিপি কুলদীপ সিংহকে যেমন মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শদাতা করা হয়েছে, এখানেও তা করা যেতে পারে। তবে রাজ্যপাল না লিখলে তা হবে না। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিপর্যয় হলে এই ধরনের রায় দিতে পারে। যা রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার মানতে বাধ্য।
রাজ্যপাল বোস তেমন কিছু করেননি। করবেন, এমন কোনও ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও সেই দাবি উঠেছে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অশান্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে। শনিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেছিলেন, ‘‘আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, পাঁচ মাসের মধ্যে এই রাজ্যের সরকার পড়ে যাবে।’’ শান্তনুর কথার প্রেক্ষিতে এক প্রশ্নের জবাবে রবিবার রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছিলেন, ‘‘সরকার পাঁচ মাস, ছ’মাস যখন খুশি পড়ে যেতে পারে। সরকার চলে বিধায়কদের সমর্থনে। বিধায়কেরা হঠাৎ মনে করল, আমরা সমর্থন করব না! আমরা অন্য কাউকে সমর্থন করব!’’
বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা দিলীপ ঘোষ আবার এর মধ্যেই সোমবার সকালে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার বাংলায় ৩৫৫ কিংবা ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করার কথা ভাবছে কি না, আমার ঠিক জানা নেই। পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনও তা হয়েছে কি না জানি না। সম্ভবত বিজেপিও কোনও রাজ্যে এটা করেনি।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মানুষের জনমতে সরকার তৈরি হয়েছে। তাকে ভেঙে দেওয়াটাও গণতন্ত্রবিরোধী।’’
তার কিছু পরেই শান্তনু বলেন, ‘‘আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। আমি বলেছি, পাঁচ মাসের মধ্যে এই রাজ্যের সরকার পড়ে যাবে। এটা বলিনি যে, সরকার ফেলে দেওয়া হবে! তবে স্বাধীনতার পরে কোথাও কখনও এমন অরাজকতা দেখা যায়নি, যেটা এখন বাংলায় হচ্ছে। এই পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে যা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে গায়ের জোরে সরকার টিকে রয়েছে। তৃণমূলের অনেকেই এ ভাবে জয় মেনে নিতে পারছেন না। সেখানে আমি শাবাশি দেব? ধান-দুর্বা দিয়ে পুজো দেব?’’
সুকান্তেরও বক্তব্য, ‘‘এখন রাজ্যের যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তাতে অনেক জায়গাতেই ৩৫৫ প্রয়োগ করার মতো অবস্থা। সরকার ফেলে দেওয়া হবে কখনওই বলিনি। বলেছি, তৃণমূলের যা অবস্থা, তাতে সরকার পড়ে যেতে পারে।’’
দুই নেতার সোমবারের বক্তব্য শুনে অনেকেই মনে করছেন, তাঁরা খানিকটা ‘সংযত’ হয়েছেন। ‘ফেলে দেওয়ার’ থেকে ‘পড়ে যাওয়া’য় বেশি জোর দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কি আছে? শাসক তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা এখনও পর্যন্ত এই বক্তব্য হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের বরং বক্তব্য, এ সব আসলে রাজ্য সরকার এবং শাসকদলের বিধায়কদের একাংশকে চাপে রাখার চেষ্টা। ঠিক যে ভাবে শাসক শিবিরের বিধায়কদের কাউকে কাউকে ইডি বা আয়কর হানার কথা বলে ‘ভয়’ দেখানো হয়। শাসক শিবিরের এক নেতার কথায়, ‘‘এ ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকার ফেলার কথা বা পড়ে যাওয়ার কথা কেউ বলে নাকি! বিজেপি তো আরওই বলবে না। আমাদের বিধায়কদের অন্য কোনও দলকে সমর্থন করার অর্থ তো ঘোড়া কেনাবেচার ইঙ্গিত দেওয়া! মহারাষ্ট্রে বিজেপির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছিল! কিন্তু এ সব কি কেউ আগে থেকে বলে করে? মহারাষ্ট্রে কী হতে চলেছে, তা কি আগে কাকপক্ষীতেও টের পেয়েছিল?’’
বস্তুত, মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার ভাঙলেও সেখানে গণতান্ত্রিক নিয়মের আওতার মধ্যে থেকেই শিন্ডে সরকার তৈরি হয়েছে। প্রথমে নিজের দল শিবসেনা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন একনাথ শিন্ডে। পরে বিজেপির সমর্থন নিয়ে সরকার গড়েছেন। উদ্ধব ঠাকরে সরকারের পতন হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক কারণে। শিবসেনার অভ্যন্তরীণ গোলমালের ফলে। বিজেপির রাজনৈতিক ভূমিকা থাকলেও সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও ‘প্রশাসনিক প্রভাব’ ছিল না। তার পরে আস্থা ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন শিন্ডে।
তবে রাজ্যে ৩৫৫ বা ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের দাবি তুললেও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে এমন দাবি নিয়ে রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব কখনও গিয়েছেন বলে জানা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনেক দূর, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার কাছেও এমন দাবি নিয়ে যাননি সুকান্তেরা। তাঁরা জানেন রাজনৈতিক ভাবে অনেক দাবি তোলা গেলেও সেই দাবি মেনে প্রশাসনিক পদক্ষেপ করাটা সহজ নয়।
কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা মনে করেন, রাজ্য সরকারের উপরে ‘চাপ’ তৈরি করার জন্য নিরন্তর এমন দাবি তোলা জরুরি। একই সঙ্গে শাসক শিবিরের বিধায়কদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রাখাটাও জরুরি যে, তাঁদের মধ্যে কেউ কি বিরোধীদলের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করছেন? এই দাবি তোলা জরুরি পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলের পর দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা রাখতেও।
‘অঙ্ক’ নয়। স্রেফ ‘কৌশল’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy