নওশাদ সিদ্দিকি। — ফাইল চিত্র।
তাঁকে তৃণমূলে আসার ‘বার্তা’ দিতেই কি নওশাদ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসের অভিযোগ দায়ের করা হল পুলিশে? ওই অভিযোগ কি আসলে তাঁর উপর ‘চাপ’ তৈরির কৌশল? পাশাপাশিই এটি কি তাঁর উদ্দেশে ‘বার্তা’? যে বার্তা বলছে, এ দিকে এলেই আর এ সব হবে না! এমন জল্পনা শাসক তৃণমূলের অন্দরেই শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে এমন আলোচনাও শুরু হয়েছে যে, পঞ্চায়েত ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের কি ‘রাজনৈতিক’ দিক থেকে ‘উচিত পদক্ষেপ’ হল? রাজনীতির কথা উঠছে, কারণ, অভিযোগকারী তরুণী নিউ টাউন থানায় যাওয়ার পর পরই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন তৃণমূলের নেতা সব্যসাচী দত্ত, যিনি দলের তরফে ভাঙড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সেই ভাঙড়, যেখানে শাসকের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে নওশাদের দল আইএসএফ। যারা ইতিমধ্যেই শাসকের ‘সাজানো’ মামলার তত্ত্ব নিয়ে সরব হয়েছে। তৃণমূলেরও একটি অংশের বক্তব্য, এতে নওশাদকে বেশি ‘গুরুত্ব’ দেওয়া হয়ে গেল। যে সমস্ত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় ‘ভাইজান’দের গণভিত্তি রয়েছে, সেই সব জায়গায় পঞ্চায়েত ভোটে এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও শাসক শিবিরের কারও কারও আশঙ্কা। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘নওশাদ টানা ৪১ দিন জেলে আটক থাকার প্রভাব যে পড়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এ বার এই অভিযোগের কোনও প্রভাবও পড়তে পারে! বিশেষত, যখন পঞ্চায়েত ভোটের মুখে হঠাৎ করে এই অভিযোগ দায়ের হল!’’
ঘটনাচক্রে, বিজেপি ছাড়া একমাত্র নওশাদই হলেন রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী বিধায়ক। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাইরন বিশ্বাস কংগ্রেসের টিকিটে জিতলেও তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তৃণমূলের অন্দরের খবর, বাগে আনতে না-পেরে নওশাদের ক্ষেত্রেও ‘বাইরন মডেল’ নিতে চাইছে তৃণমূল। এর সঙ্গে হুগলির ফুরফুরা শরিফের রাজনীতিরও একটা যোগসূত্র রয়েছে। দলের এক প্রথম সারির নেতা সম্প্রতি এক ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়েছিলেন, নওশাদকে দলে নিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে। কিন্তু ফুরফুরার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তা ফলপ্রসূ হয়ে উঠছে না। আবার নওশাদ প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, তাঁকে রাজ্যে মন্ত্রী হওয়ার ‘টোপ’ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। যদিও তৃণমূল নওশাদের সেই দাবি নস্যাৎ করেছে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, বিবিধ উপায়ে ভাঙড়ের বিধায়কের উপর ‘চাপ’ তৈরি করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের তারই অঙ্গ বলে মনে করছেন অনেকে। বস্তুত, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির কোনও বিধায়ককে শাসকের এ হেন ‘রোষ’-এর মুখে পড়তে হয়নি। বিজেপির কোনও বিধায়কের বিরুদ্ধে পুলিশে এই ধরনের অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। যার প্রেক্ষিতে নওশাদ অনুগামীদের বক্তব্য, রাজনৈতিক ভাবে যুঝতে না পেরে এখন মহিলা-ঘটিত কেসে ‘ফাঁসিয়ে দেওয়া’র চেষ্টা করছে তৃণমূল।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, ভাঙড় পরিস্থিতি এবং নওশাদকে নিয়ে ‘চিন্তা’র কারণ আছে। কারণ, পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বে নওশাদের দল আইএসএফ শাসক তৃণমূলকে ‘বেগ’ দিয়েছে। নওশাদের দলের সমর্থকদের ভয়ে তৃণমূলের ‘ডাকাবুকো’ লোকজনকেও পালাতে দেখা গিয়েছে। এমনকি, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নওশাদকে ‘দুষ্কৃতী’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ভাঙড়ে তৃণমূল ‘প্রতিরোধ’ করেছে। মাঠ-ময়দানের রাজনীতিতে যদি বিরোধীরা ‘প্রতিরোধ’-এর তত্ত্ব দেয়, তখন বুঝতে হয়, তাদের ‘দাপট’ বেড়েছে। একই ভাবে, শাসকদল যখন ‘প্রতিরোধ’ করার কথা বলে, তখন রাজনীতির কারবারিরা বুঝে নেন, সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাদের দাপট কমেছে। ভাঙড়ে নওশাদ এবং তাঁর অনুগামীদের সামলাতে গিয়ে শাসক তৃণমূলকে যদি ‘প্রতিরোধ’-এর রাস্তায় যেতে হয়, তা হলে সেখানকার পরিস্থিতি অনুমান করা কঠিন নয়।
প্রসঙ্গত, বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফেরার পর সে অর্থে ‘ভাঙড় পরিস্থিতি’ সামলানোই সল্টলেকের প্রাক্তন মেয়র তথা বর্তমান চেয়ারম্যান সব্যসাচীর কাছে প্রথম ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সাংগঠনিক দায়িত্ব। তৃণমূলের একটি অংশ (যাঁরা সব্যসাচী-বিরোধী হিসেবেই পরিচিত) ঘরোয়া আলোচনায় এমনও বলছেন যে, দলের মার্কশিটে নম্বর বাড়াতে এই ক্ষেত্রে তাঁকে কিছুটা ‘অত্যুৎসাহী’ এবং ‘অতিসক্রিয়’ দেখিয়েছে। সব্যসাচী অবশ্য বলেছেন, “ওই তরুণীকে আমি চিনি না। তাঁর ভাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁরা একেবারেই সাধারণ পরিবারের। কোন এলাকা, কোন থানা— অতশত বোঝেন না। নিউ টাউন ‘আমার এলাকা’ ভেবে যোগাযোগ করেন। ওঁরা থানায় পৌঁছনোর অনেকটা পরে আমি সেখানে যাই।” তাঁর আরও দাবি, “এটা কোনও ভাবেই রাজনৈতিক বিষয় নয়। হতে পারে না! কেউ রাজনীতি করলেই তাঁর যা খুশি করার অধিকার জন্মায় না।”
তৃণমূলের একটি অংশের দাবি, ওই তরুণীর অভিযোগ ১০০ শতাংশ সঠিক। অভিযোগকারিণী ও তাঁর পরিবারের লোক থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হতেনই। ঘটনাচক্রে, গোটা বিষয়টা দলের কাছে চলে এসেছে। দলের এক নেতার কথায়, “দলের তরফেই বলা হয়েছে, ভোটের আগে যেন এ নিয়ে বেশি হইহই না করা হয়। আবার এ-ও ঠিক যে, এই ধরনের ঘটনা শুনে রাজনৈতিক সমীকরণের কথা মাথায় রেখে কোনও সংবেদনশীল লোক চুপ করে থাকতে পারে না।”
অনেকে এর মধ্যে অতীতের ‘ছায়া’ দেখছেন। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সাগরদিঘি উপনির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী বাইরনের ক্ষেত্রেও মহিলা-ঘটিত অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। যে কারণে ভোটের আগে আদালত থেকে রক্ষাকবচও নিতে হয়েছিল তাঁকে। ভোটে জেতার তিন মাসের মধ্যে বাইরন তৃণমূলে যোগ দেন। অনেকে বলছেন মানস ভুঁইয়ার কথা। ২০১৬-র ভোটের সময়ে তৎকালীন কংগ্রেসের নেতা মানসের নাম জোড়া খুনের চার্জশিটে ছিল। পরে মানস কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যান। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, তার পরে তাঁর নাম আর চার্জশিটে দেখা যায়নি। মানস সবংয়ের বিধায়কের পদ ছেড়ে তৃণমূলের হয়ে চলে যান রাজ্যসভায়। তাঁর ছেড়ে-যাওয়া আসনটিতে উপনির্বাচনে দাঁড়ান মানসের স্ত্রী গীতা ভুঁইয়া। তিনিও জিতে বিধায়ক হন। ২০২১ সালে আবার বিধানসভা ভোটে লড়েন মানস। জিতে আবার বিধায়ক হন। তার পরে মন্ত্রী। এই দুই ঘটনার সঙ্গেই অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন অধুনা কারাবন্দি অনুব্রত মণ্ডলের কথাও। বছর কয়েক আগে প্রকাশ্য সভায় তাঁকে এক স্থানীয় বিজেপি নেত্রী সম্পর্কে গাঁজা কেস ‘দেওয়ার’ নির্দেশ দিতে শোনা গিয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy