Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Intellectuals are thinking about the wall-row

পাঁচিল আর না-পাঁচিল, সংলাপের অভাবই কি সমস্যার মূলে?

বিশ্বভারতীর এই ‘পাঁচিল বিতর্ক’ নতুন কিছু নয়। বিশ্বভারতীর এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরার কাজ শুরু হয়েছিল উপাচার্য সুজিতকুমার বসুর আমলে। উপাচার্য রজতকান্ত রায়ের আমলে তা গতি পায়।

বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য রক্ষার আবেদন নিয়ে বিদ্বজ্জনদের একাংশ এক খোলা চিঠিও প্রকাশ করে। নিজস্ব চিত্র।

বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য রক্ষার আবেদন নিয়ে বিদ্বজ্জনদের একাংশ এক খোলা চিঠিও প্রকাশ করে। নিজস্ব চিত্র।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:০৪
Share: Save:

এ যেন অনেকটা যন্ত্র দিয়ে মুক্তধারার জল আটকানোর বিতর্ক। যাঁরা ভাঙতে চান, তাঁদের পক্ষে যুক্তি রয়েছে। যাঁরা আটকাতে চান, তাঁদের পক্ষেও যুক্তি যথেষ্ট। বিশ্বভারতীর নিজস্ব এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হবে কি হবে না, এই বিতর্কে উত্তাল ভুবনডাঙা। আলোড়ন এসে লাগছে রাজ্য-রাজনীতিতেও। বিশ্বভারতীর এই ‘পাঁচিল বিতর্ক’ নতুন কিছু নয়। এক দিকে এক ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয় আর অন্য দিকে এক ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। পাল্লার এ পাশে যদি থেকে থাকে নিরাপত্তার যুক্তি, অন্য দিকে থাকছে পরিবেশ বা স্থানীয় অর্থনীতির নির্ভরশীলতার যুক্তি। এ সবের বাইরে আর এক যুক্তির রাজ্য বর্তমান। সেটা, আদর্শের যুক্তি, রবীন্দ্র-ভাবধারার সঙ্গে ‘পাঁচিল’ নামক প্রতিষ্ঠান-প্রতীকের সঙ্ঘাতের যুক্তি।

বিশ্বভারতীর এই ‘পাঁচিল বিতর্ক’ নতুন কিছু নয়। বিশ্বভারতীর এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরার কাজ শুরু হয়েছিল উপাচার্য সুজিতকুমার বসুর আমলে। উপাচার্য রজতকান্ত রায়ের আমলে তা গতি পায়। বিশ্ববিদ্যালয় তথা আশ্রমের নিরাপত্তার কারণে যে পাঁচিল প্রয়োজন, সে কথা রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরির পরে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম এসে জানতে চেয়েছিলেন, পাঁচিল নেই কেন। সেই সময় থেকে পাঁচিল-বিবাদ বহমান। ওদিকে শান্তিনিকেতনকে ঘিরে ঘনিয়ে উঠেছে নাগরিক আবাসনের একটা বিপুল আয়োজন। আশ্রমের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বহুতল আহুনিক ইমারত। দিনে দিনে বেড়েছে হোটেলের সংখ্যা। পশ্চিমবঙ্গ সফরনামার ‘গোল্ডেন ট্র্যাঙ্গল’ (তারাপীঠ-বক্রেশ্বর-শান্তিনিকেতন) ঘিরে পর্যটন শিল্পের রমরমা ইত্যাদি যে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়, তা অস্বীকার করতে পারেন না কেউই। এর মধ্যেই ঘটে যায় নোবেল পদক চুরি বা উপাসনা গৃহে বসে মদ্যপান ইত্যাদির মতো ঘটনা। পৌষমেলার মাঠে বাইকবাজদের দৌরাত্ম্য বা সন্ধের পরে সেখানে মদ্যপানের আসরের মতো ব্যাপারকে উড়িয়ে দিতে পারেন না স্থানীয় মানুষও। তা হলে তো সত্যিই পাঁচিল প্রয়োজন! কিন্তু, ওই যে, খাঁচার পাখি আর বনের পাখির সংলাপ-লেখকের আদর্শ, ‘মুক্তধারা’-র আদর্শ, ‘অচলায়তন’ হয়ে ওঠার আশঙ্কা— এগুলিকেও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না! সঙ্গে জড়িয়ে থাকছে পরিবেশ-সংক্রান্ত প্রশ্নও।

সম্প্রতি পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল তোলা নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। কর্তৃপক্ষের তোলা পাঁচিল ভেঙে দিয়েছেন স্থানীয়রা। এই অবসরে পাঁচিল-বিবাদকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে রাজনীতিও। ‘প্রো-পাঁচিল’ আর ‘নো-পাঁচিল’— এমন এক লম্বালম্বি বিভাজনও যেন ঘটে গিয়েছে এই সব কাজিয়ার ফাঁকেই। রাজ্যের বিদ্বজ্জনদের একাংশ এক খোলা চিঠি প্রকাশ করে বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কারও কায়েমি স্বার্থ যাতে এই বিবাদে জড়িয়ে না পড়ে, সে দিকেও দৃষ্টিদানের আবেদন রেখেছেন। এমন অবস্থায় প্রশ্ন জাগতেই পারে, কী ভাবছেন এ রাজ্যের বিবুধ মানুষরা? কী ভাবছেন শান্তিনিকেতনের সঙ্গে স্মৃতিবিজড়িত হয়ে থাকা গুণীজন?

আরও পড়ুন: আমাদের গালে হাত বুলিয়ে সবাই বলল, গুরুর ছোঁয়া আছে

নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেন জানালেন, “১৯৮০-’৮২ সাল থেকে শান্তিনিকেতন যাচ্ছি। বন্ধুদের অনেকেই সেখানে পড়েছেন। এখনও অনেকেই যুক্ত রয়েছেন বিশ্বভারতীর সঙ্গে। এই দীর্ঘ যোগাযোগের ফলে এই জায়গাটার প্রতি যে খানিক দুর্বলতা থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি জানি, এই পাঁচিলের ব্যাপারটা আসলে জমি দখলের লড়াই। রাজনৈতিক ও বাস্তবিক— দু’রকম জমি দখলের কথাই বলছি। কোনটা আশ্রমের জমি, তা যদি চিহ্নিত করতেই হয়, তা হলে তারের বেড়াই যথেষ্ট। এতে অনেকটা উন্মুক্তও থাকে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘শ্রীনিকেতনের আগে একটা পড়ে থাকা মাঠকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। বিশ্রী ব্যাপার! আসলে, পাঁচিল বিষয়টাই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে, আশ্রমিকদের সঙ্গে, আশ্রমের আদর্শের সঙ্গে যায় না। সীমানা নির্দেশের দরকার পড়লে কর্তৃপক্ষ গাছ লাগিয়ে সীমানা নির্দেশ করুন না। তারের বেড়ার গায়ে লতা গজানোই বা মন্দ কিসে! ফটক করতে হলে বড় দুটো তালগাছ তোরণের কাজ করতে পারে, তাতে গেট লাগান না। সীমানা তাতেও তো নির্ধারিত হবে।”

পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল তোলা নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। নিজস্ব চিত্র।

ব্যাপারটা শুধু যে সীমানা নির্ধারণে আটকে নেই, এর সঙ্গে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত, এই প্রশ্ন করলে সঙ্গীতকার দেবজ্যোতি মিশ্র বললেন, “পাঁচিল কি সব সময়ে নিরাপত্তা দেয়? যে কারণে বিশ্বভারতীর জন্ম, মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় যোগাযোগের যে লক্ষ্য নিয়ে এই শিক্ষায়তন গঠিত, তার সঙ্গে পাঁচিল ব্যাপারটা মানায় কি?” তা হলে নিজের জমি-সম্পত্তিকে সুরক্ষিত রাখতে, বহিরাগতের উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে কী করা যায়? দেবজ্যোতিবাবু জানালেন, “বিশ্বভারতীর পাঁচিল তো বরাবর ছিল না। অবশ্য এখন দিন বদলেছে। আমার নিজের জমিতে যদি বহিরাগতের উপদ্রব দেখা দেয়, আমি অবশ্যই নিরাপত্তার কথা ভাবব। সে ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী কেন, যে কোনও মানুষেরই অধিকার রয়েছে পাঁচিল তোলার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে জীবনদর্শন থেকে বিশ্বভারতী তৈরি করেছিলেন, তার সঙ্গে পাঁচিল মানায় না। নোবেল পাওয়ার পরে তো তিনি লন্ডনে গিয়েও থাকতে পারতেন। তা না করে বীরভূমের ওই এক পড়ে থাকা মাঠে কেন গড়ে তুললেন এমন এক শিক্ষাশ্রম! আসলে মনে হয়, আমরা তাঁর ভাবনার বিশ্বভারতী থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। এই দূরত্ব সময়ের শুধু নয়, সভ্যতার, মানসিকতার। এ-ও তো ঠিক যে, উপাসনাগৃহে উপদ্রব কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। আর উপদ্রবও এক দিনে শুরু হয়নি। তা হলে এত দিন পাঁচিল ছিল না কেন? এই ক’বছরেই বা কেন পাঁচিলের প্রসঙ্গ আসছে?”

যদি সময় বদলে যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় মানসিকতাও, তা হলে পাঁচিল তুলে সীমানা ও নিরাপত্তা বিধান নিয়ে বিবাদের অবকাশটা কোথায়? অর্থনীতিবিদ সুপর্ণ মৈত্র জানালেন, “আমি থাকি কলকাতায়, বিশ্বভারতী থেকে অনেকটাই দূরে। ঘটনা সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা গড়ে উঠছে টিভি বা সংবাদমাধ্যম মারফত। এই দূরবর্তী অবস্থান থেকে আমার মনে হয়, কোথাও একটা কমিউনিকেশনের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অন্যপক্ষীয়দের একটা সংলাপ প্রয়োজন ছিল।’’ তিনি বলছেন, ‘‘এখানে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের একটা দায় থেকেই যাচ্ছে। সর্বোপরি এই পাঁচিল পরিবেশের ক্ষতি করছে কি করছে না, সে বিষয়ে বিস্তারিত কথোপকথনের প্রয়োজন ছিল। আবার এ কথাও মানতে হবে যে, গায়ের জোরে কেউ কিছু করতে পারেন না। কেউ জোর করে কোনও কনস্ট্রাকশন ভেঙে দিতে পারেন না। এখানেও সংলাপের অভাবটাই প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

সংলাপের যে প্রয়োজন ছিলই, সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠল কবি জয় গোস্বামীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। তাঁর কথায়: “যত বার পৌষমেলার প্রাঙ্গনে গিয়েছি, তত বার উদার, প্রশস্ত এক আঙিনায় এসে দাঁড়ানোর অনুভব হয়েছে। মেলা চলাকালীন যখন গিয়েছি, তখন সকলের সঙ্গে সম্মিলনের অনুভব জন্মেছে। যখন পৌষ মেলা চলছে না, মাঠ ফাঁকা পড়ে আছে, তখন সেই মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটেছি, বন্ধুর সাইকেলের সামনে বসে ঘুরেছি। প্রতি বারই মনে হয়েছে, এর পিছনে এক মানুষের চিন্তা কাজ করেছে— এই প্রাঙ্গন সকলের মেলামেশার পরিসর। একে কেন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হবে, তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই।’’ জয়ের অভিমত, ‘‘এই সিদ্ধান্ত যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা প্রশাসক। বিশ্বভারতী একটা ইউনিভার্সিটি। সেটা চালাতে গেলে উপাচার্যকে প্রশাসক হতে হয়। প্রশাসকের যুক্তি নিশ্চয়ই কিছু রয়েছে। সেটা বোঝার শক্তি আমার নেই। তাই আমি সেই উদার, প্রশস্ত সম্মিলনের পরিসরটিকেই আমার মনে ধরে রাখতে চাই। কোনও পাঁচিল ঘেরা পরিসর আমার কল্পনায় আসছে না।”

আরও পড়ুন: ফ্লপ মাস্টার থেকে মহাতারকা, সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, গানও গেয়েছেন উত্তম​

তা হলে প্রশ্ন গিয়ে ঠেকছে সেই সংলাপে? প্রশাসকের যুক্তির সঙ্গে মানুষের অনুভবের, আবেগের। ভুবনডাঙা নামটির মধ্যেই যে ঔদার্যের প্রকাশ, তাকে কি ইটের পাঁচিল আবদ্ধ রাখতে পারে? আবার একই সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে, একটা বিশ্ববিদ্যালয় যদি একাধারে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন আর মহানগরের উপছায়ায় পরিণত হয়, তা হলে কী বিপদ ঘটতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন বিদ্যাচর্চার নিভৃতি। যাকে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন আম্রকুঞ্জের উন্মুক্ততায়, দিগন্ত প্রসারিত মাঠের মাঝখানে। কিন্তু, কাল তার নিজের নিয়মেই বদলে দেয় সব কিছুর সংজ্ঞা। বদলে দেয় নিভৃতির মাপকাঠিগুলিও। প্রান্তরের জনবিরলতা, নাকি পাঁচিল ঘেরা নিরাপত্তার ঘেরাটোপের একটি কোণ— এ নির্ধারিত হতে পারে সংলাপের মাধ্যমেই। কী দাঁড়াবে ভুবনডাঙার ভবিষ্যৎ, তা নির্ধারণ করুক প্রশাসন আর অন্য পক্ষীয়দের চিন্তার পারস্পরিক আদানপ্রদান, এ পর্যন্ত বলে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা সামনে খোলা থাকছে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Viswa Bharati Intellectuals
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE