‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনেত্রী তনুজা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
চুয়াল্লিশ বছর আগে-পরে। ৪৪ বছর আগে ১৯৮১ সালে অধুনাপ্রয়াত তপন সিংহের রচিত ও পরিচালিত ছবি ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ মুক্তি পেয়েছিল। যে ছবিতে এক তরুণী গোপালপুরে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষিতা হন। ছবিটি মূলত সেই মামলার বিচার এবং তার ফলাফল নিয়ে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী তনুজা। পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সদ্যপ্রয়াত অভিনেতা মনোজ মিত্র। ২৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির পুরস্কার পেয়েছিল ছবিটি।
চুয়াল্লিশ বছর কেটে গিয়েছে। গত ৯ অগস্ট থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত এমনই ঘটনাপ্রবাহ দেখলেন গোটা রাজ্যের এবং দেশেরও মানুষ। যেখানে নির্যাতিতার বিচার চাওয়া হল। আদালতে দীর্ঘ সওয়াল-জবাবও হল। সেখানে বহু প্রশ্ন, বহু দাবি উঠেছে। তদন্ত নিয়ে যুক্তি দিয়েছে সিবিআই এবং পুলিশ। কখনও সহমত হয়েছেন জুনিয়র ডাক্তার এবং নির্যাতিতার বাবা-মা, কখনও বিরোধিতা করেছেন। প্রকাশ্যে এসেছে বিচারপতিদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণও। আবার দোষী সাব্যস্ত হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের মুখে শোনা গিয়েছে তাঁকে ‘ফাঁসানো’র তত্ত্বও!
গত বছরের ৯ অগস্ট আরজি করের ঘটনার তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশ পরের দিনই (১০ অগস্ট) সঞ্জয়কে গ্রেফতার করেছিল। আদালতে তদন্তকারীরা দাবি করেন, ‘মূল অভিযুক্ত’ তিনিই। ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত ‘ব্লুটুথ’ হেডফোনের ছেঁড়া অংশ, সিসি ক্যামেরা ফুটেজ খতিয়ে দেখেই সেই দাবি করে লালবাজার। তবে পুলিশি তদন্তে সন্তুষ্ট হতে পারেনি নির্যাতিতার পরিবার। কলকাতা হাই কোর্টে সিবিআই তদন্ত চেয়ে মামলা দায়ের হয়। গত ১৩ অগস্ট হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম মামলার কেস ডায়েরি খতিয়ে দেখে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন।
হাই কোর্টে মামলা চলাকালীনই সুপ্রিম কোর্ট ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ ভাবে আরজি কর মামলা নিজেদের হাতে নেয়। এখনও পর্যন্ত দেশের শীর্ষ আদালতে সেই মামলার ১০টি শুনানি হয়েছে। প্রতি শুনানিতেই সিবিআই তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে ‘স্টেটাস রিপোর্ট’ জমা দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে। সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল-জবাবের পাশাপাশি শিয়ালদহ আদালতেও মামলার শুনানি হয়েছে টানা। তদন্ত শেষে ধর্ষণ-খুনের মামলায় চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। সেই চার্জশিটের ভিত্তিতে চার্জগঠনের পর শুরু হয় বিচারপ্রক্রিয়া। বিচারক অনির্বাণ দাসের এজলাসে ৫০ জনের বেশি সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। আদালতে নিজের মতামত জানায় সিবিআই। পাল্টা সঞ্জয়ও নিজের কথা বলেন বিচারকের সামনে। নির্যাতিতার বাবা-মাও লিখিত বক্তব্য জানান নিম্ন আদালতে। সেই সব বিচার করেই রায় ঘোষণা করলেন বিচারক।
আরজি কর মামলায় তদন্ত শেষে সিবিআই জানায়, এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত এক জনই। সঞ্জয় রায়। তদন্তের স্বার্থে সঞ্জয়ের পলিগ্রাফ পরীক্ষাও করায় তারা। ঘটনার সময় সঞ্জয়ের পরনে যে টিশার্ট এবং ট্রাউZeর ছিল, তা-ও ফরেন্সিক পরীক্ষা করানো হয়। আদালতে সেই সব তথ্যপ্রমাণের কথা জানায় সিবিআই। বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন সিবিআই দাবি করে, ‘‘আমরা অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’’
শুধু কি সঞ্জয়ই একা জড়িত? আদালতে বার বার এই প্রশ্ন ওঠে। নির্যাতিতার বাবা-মা আদালতে দাবি করেন, তাঁরা আরও তদন্ত চান। বিভিন্ন প্রশ্ন এবং সন্দেহের কথাও জানান বিচারককে। তাঁদের দাবি, ওই ঘটনা একা ঘটাতে পারে না কেউ! কারা কারা জড়িত, তা খুঁজে বার করতে হবে। জুনিয়র ডাক্তারদের গলাতেও একই দাবির কথা শোনা গিয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘একার পক্ষে কি এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব? সকলের অলক্ষে সেমিনার রুমে সঞ্জয় কী ভাবে পৌঁছলেন? বড়সড় যোগসাজশ ছাড়া এটা হতে পারে না।’’ সঞ্জয় ছাড়া ওই ঘটনায় আর কেউ জড়িত রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন একেবারে উড়িয়ে দেয়নি সিবিআইও। আদালতে তারা জানায়, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। উল্লেখ্য, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সিবিআই আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছিল। যদিও সিবিআই চার্জশিট দিতে না পারায় ওই মামলায় জামিন পান দু’জনেই।
গ্রেফতারির পর পরই পুলিশ আদালতে দাবি করেছিল, জেরায় ধর্ষণ এবং খুনের কথা স্বীকার করেছেন সঞ্জয়। যদিও বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তাঁর মুখেই শোনা গিয়েছে ভিন্ন সুর। বিচারকের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি কিছু বলতে চাই। আমায় বলতে দেওয়া হোক। না হলে সব দোষ আমার উপর আসবে।’’ সুযোগ পেয়ে সঞ্জয় দাবি করেন, ‘‘আমি নির্দোষ।’’ আদালতে তাঁর পক্ষের আইনজীবীদের দাবি, ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না সঞ্জয়। যে ব্লুটুথ হেডফোনের কথা বলা হচ্ছে, তা তাঁদের মক্কেলের নয়। সঞ্জয়ের জামাকাপড়ও ছেঁড়া ছিল না। তাঁর মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়েও সন্দেহপ্রকাশ করেন সঞ্জয়ের আইনজীবীরা। তবে বার বার জামিনের আবেদন করলেও তা খারিজ হয়।
অন্য দিকে, সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানিতে একাধিক প্রশ্ন ওঠে। সরকারি হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয় রাজ্য। তবে রাজ্যের তরফে জানানো হয়, তারা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। হাসপাতালের সুরক্ষা নিয়ে প্রতি শুনানিতেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে রাজ্য। তবে সব সময় রাজ্যের যুক্তি মানতে রাজি ছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সেই সঙ্গে আরজি কর হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। আদালতের নির্দেশেই সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। গঠন করা হয় টাস্ক ফোর্সও। ঘটনার পর প্রাক্তন অধ্যক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে শীর্ষ আদালতে। প্রশ্ন ওঠে, ‘‘এফআইআর করতে ১৪ ঘণ্টা দেরি হল কেন?’’ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো নথি উধাও হওয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিচারপতিরা। সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন ওঠে শীর্ষ আদালতে।
চুয়াল্লিশ বছর আগে ১১২ মিনিটের একটি ছবিতে আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছিলেন ধর্ষিতা। তাঁকে খুন হতে হয়নি। তপন সিংহের রচিত কাহিনিতে আদালতে ধর্ষণের ন্যায়বিচার চাওয়া-পাওয়ার ঘটনাটিই মুখ্য ছিল। চুয়াল্লিশ বছর পরে টানা ৫৯ দিনের বিচারপ্রক্রিয়া দেখল গোটা রাজ্য। যেখানে বাস্তব হয়ে দাঁড়াল ‘আদালত ও একটি মেয়ে’। ছবির কাহিনি ছিল ইচ্ছাপূরণের। বাস্তবের কাহিনি?
(ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় যত ক্ষণ না অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর নাম, পরিচয় প্রকাশে আইনি বাধা থাকে। আনন্দবাজার অনলাইন সেই নিয়ম মেনেই আরজি কর পর্বের প্রথম দিন থেকে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নাম বা ছবি প্রকাশ করেনি। শনিবার আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় আমরা তাঁর নাম এবং ছবি প্রকাশ করা শুরু করছি।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy