Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
RG Kar Medical College and Hospital Incident

‘থ্রেট কালচার’ কী? বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে কী ভাবে চলত সেই ‘সংস্কৃতি’? কারা চালাতেন? জেনে নিন

আরজি কর-কাণ্ডের আবহে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘হুমকি সংস্কৃতি’র অভিযোগ নতুন করে উঠে এসেছে। কারা করতেন এ সব? কাদের দেওয়া হত হুমকি? নেপথ্যে কি কোনও ‘লবি?

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সারমিন বেগম
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:১৩
Share: Save:

পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তার মধ্যে পঞ্চম তথা শেষ দফা দাবিটি হল রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে ‘ভয়মুক্ত পরিবেশ’ গড়ে তুলতে হবে। ‘থ্রেট কালচার’ বা ‘হুমকি সংস্কৃতি’ শেষ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে ‘দাদাগিরি’।

কিন্তু কী সেই ‘হুমকি সংস্কৃতি’? বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে কোন ভয়ের অভিযোগ বার বার তুলছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা? কী ভাবে ভয় দেখানো হয়?

মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘হুমকি’ থেকেই জন্ম এই শব্দবন্ধের। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কলেজে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তার পরে অনেক ক্ষেত্রেই কলেজের সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারি পড়ুয়া এবং জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের দাবি, র‌্যাগিংয়ের মতো ‘থ্রেট কালচার’ কয়েক দিনের বিষয় নয়। লাগাতার চলত ‘দাদাগিরি’ এবং ‘হুমকি’।

জুনিয়র ডাক্তার এবং ডাক্তারির ছাত্রদের একাংশের দাবি, ২০২০-’২১ সাল থেকে মেডিক্যাল কলেজে ‘দাদাগিরি’-র বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে থাকে। নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। তাঁদের দাবি, এর পিছনে রয়েছে ‘আনুগত্য’ লাভের ইচ্ছা এবং ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা। জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ টাকার বিষয়টিও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তাঁদের দাবি, হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ও চলত মেডিক্যাল কলেজে। তবে আনুগত্য আদায় এবং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার বিষয়টি তার চেয়েও বেশি। কয়েক বছর আগে রাজ্যের এক সরকারি হাসপাতালে কয়েক জন চিকিৎসককে মারধর করার অভিযোগ উঠেছিল। তাঁরা এখন ‘পিজিটি’ করছেন। ভয় দেখাতেই ওই চিকিৎসকদের মারধর করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। সে সময়েও আন্দোলনের পথে হেঁটেছিলেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, ওই ঘটনার সময় থেকেই সংগঠিত হতে থাকেন ডাক্তারি পড়ুয়া এবং চিকিৎসকেরা।

তখন থেকেই ‘দাদা’-দের আশঙ্কা হয়, পরিস্থিতি হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। তখন থেকেই ভয় দেখানো আরও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে হুমকি। এক এক জনকে এক রকম ভাবে ভয় দেখানো হত। যাঁরা এমবিবিএস পড়ছেন, তাঁদের ‘ফেল’ করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত। হাউস স্টাফদের বলা হত, রেজিস্ট্রেশন আটকে দেওয়া হবে বা বাতিল করানো হবে। হুমকি দেওয়া হত ‘কাউন্সেলিং’ নিয়েও। সিনিয়র ডাক্তারদের আবার হুমকি দেওয়া হত বদলি করে দেওয়ার। এমনকি, চিকিৎসক পড়ুয়াদের হস্টেলে ‘ভাল ঘর’ দেওয়া হবে না বলেও ভয় দেখানো হত।

এসএসকেএম হাসপাতালের সিনিয়র রেসিডেন্ট বিপ্রেশ চক্রবর্তী এখন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে ডিএম করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সকলকে এক ভাবে হুমকি দেওয়া হত না। কাউকে ফেল করানোর ভয় দেখানো হত। কাউকে বদলি, কাউকে আবার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়ার ভয় দেখানো হত। এ ভাবেই চাপে রাখা হত।’’ তিনি জানিয়েছেন, সব সময় যে সিনিয়রেরা জুনিয়রদের হুমকি দিতেন, তেমন নয়। উল্টোটাও হত। বিপ্রেশের কথায়, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেত, যাঁরা ইন্টার্নশিপ করছেন, তাঁরা গিয়ে সিনিয়রদের কাউকে কাউকে ধমকাচ্ছেন। হুমকি দিচ্ছেন। আসলে থ্রেট কালচারের মাথারা জুনিয়রদের দিয়ে ওই হুমকি দেওয়াতেন। ফলে সেই জুনিয়র নিজেকে হিরো মনে করতেন। আর যাঁকে হুমকি দেওয়া হত, সেই সিনিয়র লজ্জায় পড়ে যেতেন। গ্লানিতে ভুগতেন।’’

কী ভাবে এমবিবিএসে ফেল করানো হত? চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, যাঁদের আনুগত্য ‘দাদা-রা আদায় করতে পারতেন না, তাঁদের কখনও প্র্যাকটিক্যালে ফেল করিয়ে দেওয়া হত। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ফলাফলের ‘রিভিউ’ করা যায় না। ফলে সমস্যায় পড়তেন সংশ্লিষ্ট পড়ুয়া। আরও অভিযোগ, যে ডাক্তারি পড়ুয়াদের আনুগত্য মিলত না, তাঁরা যখন ইন্টার্নশিপ করতেন, তখনও বিভিন্ন ভাবে সমস্যা তৈরি করা হত। তাঁকে ইন্টার্নশিপের শংসাপত্র দেওয়া হত না। ওই পড়ুয়া যে সিনিয়র ডাক্তারের অধীনে ইন্টার্নশিপ করতেন, তাঁকেও হুমকি দেওয়া হত। চিকিৎসকদের অভিযোগ, এ সবের নেপথ্যে খাতায়কলমে একটা ‘লবি’ কাজ করত। সেই ‘লবি’-র অধীনে থাকলে মিলত সুবিধা।

চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, হুমকি দেওয়ার নেপথ্যেও সক্রিয় থাকত ওই ‘লবি’। যেটি ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ বলেই চিকিৎসক মহলে পরিচিত। একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, ওই ‘লবি’ সমস্ত সরকারি হাসপাতালেই ‘সক্রিয়’। ফলে কোনও জুনিয়র ডাক্তার হেনস্থার শিকার হয়ে অন্য কোনও হাসপাতালে চলে গেলেও মুক্তি মিলত না। সেখানেও তাঁকে হুমকি দেওয়া হত।

আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসক জ়ুনিথ সিংহের অভিযোগ, ‘‘আমি তিন-সাড়ে তিন বছর ধরে এই হুমকি সংস্কৃতির শিকার। আমরা কয়েক জন বিভিন্ন দাবি নিয়ে সরব হয়েছিলাম। যাঁরা প্রতিবাদের সামনের সারিতে ছিলাম, তাঁদের নিশানা করা হয়। হস্টেল থেকে জোর করে বার করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে ফতোয়া জারি করে জানানো হয়, অডিটোরিয়ামে ঢুকতে পারব না। তখন অডিটোরিয়ামে হয়তো কোনও অনুষ্ঠান বা কর্মসূচি চলছে।’’ জ়ুনিথের দাবি, ‘‘সেখানেই হেনস্থার শেষ নয়। কেউ হয়তো এমবিবিএসের কোনও বিষয়ের থিয়োরিতে ৭২ শতাংশ পেয়েছেন। অথচ প্র্যাকটিক্যালে পাশ করেননি। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ফলাফলের যে হেতু রিভিউ হয় না, তাই প্রশ্ন করে লাভ নেই।’’ আর এক চিকিৎসকের অভিযোগ, ‘দাদা’-রা যে পিজিটি পড়ুয়ার আনুগত্য পেতেন না, তাঁকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দেওয়া হত। কঠিন চিকিৎসার ‘কেস’ দেওয়া হত, যাতে পিজিটি শেষ করতে দেরি হয়ে যায়।

‘হুমকি’র মুখে ‘দাদা’-রা আনুগত্য পেলে কী কী সুবিধা মিলত, সে কথাও জানিয়েছেন বিপ্রেশ। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতার কোনও হাসপাতালে কোনও নির্দিষ্ট বিভাগের হাউস স্টাফ পদটাই হয়তো ছিল না। দেখা গেল, হঠাৎ একটি পদ গঠন হল। বিজ্ঞপ্তি জারি হল। তার পরে দেখা গেল, যিনি হুমকি দিচ্ছিলেন, তিনিই হয়তো পদটি পেয়ে গেলেন। দেখানো হচ্ছে, তিনি পদ পাওয়ার যোগ্য। কবে পদ তৈরি হল? কেন এক জনই সুযোগ পেলেন? উত্তর নেই। বিস্তারিত জ্ঞান ছাড়াও অনার্স পেয়েছেন কেউ কেউ।’’ বিপ্রেশের অভিযোগ, যাঁরা ওই চক্র বা লবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, তাঁদেরই সুবিধা দেওয়া হত।

আন্দোলনরত চিকিৎসকদের অনেকের বক্তব্য, ধমকাতে বা চমকাতে পারবেন, এমন জুনিয়র ডাক্তার বা ডাক্তারি পড়ুয়াকেই হুমকি দিতে বলা হত। বদলে তিনি নিশ্চিত থাকতেন ডিগ্রি পাওয়ার ব্যাপারে। পাশ করার চিন্তা থাকত না। ফলে পড়াশোনা থেকে তাঁর নজর সরে যেত। পাশাপাশি, তিনি ‘দাদা’দের সুনজরে থাকতেন। নিজেরও একটা ‘দাপট’ থাকত।

চিকিৎসকদের একাংশ আরও মনে করেন, দীর্ঘ দিন মেডিক্যাল কলেজগুলিতে নির্বাচন না হওয়ার কারণে জাঁকিয়ে বসেছিল ‘থ্রেট কালচার’। আন্দোলনকারী চিকিৎসদের পঞ্চম দফার দাবিতে ওই নির্বাচন করানোর কথাও বলা হয়েছে। কোভিড-সহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ দিন মেডিক্যাল কলেজে নির্বাচন হয়নি। চিকিৎসক দ্বৈপায়ন মজুমদার বলেন, ‘‘মেডিক্যাল কলেজগুলিতে দীর্ঘ দিন নির্বাচন না হওয়াটাও থ্রেট কালচার জাঁকিয়ে বসার বড় কারণ। কোনও কোনও কলেজে ২০১৭ সালে শেষ বার নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন না হওয়ার ফলে কারও দায়িত্ব নেই। অথচ সকলে দায়িত্বহীন ক্ষমতা ভোগ করতে চাইছেন। সে কারণে হুমকি দিয়ে কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করা হত।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাম আমলে আমি বাম-বিরোধী হয়ে ভোটে লড়েছি। জিতেওছি এক বার। তখন নির্বাচন করানো হত। সেই নির্বাচনের গুরুত্বও ছিল। এখন নির্বাচন হয় না। তাই সমান্তরাল ক্ষমতাকক্ষ তৈরি হয়েছে।’’

আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা মনে করেন, এই কারণেই দাপট বৃদ্ধি পেয়েছে অভীক দে, বিরূপাক্ষ বিশ্বাসদের। কলেজে কলেজে ভয় দেখিয়ে তাঁরা আনুগত্য আদায় করেছেন। বিরূপাক্ষের সঙ্গে এক জুনিয়র ডাক্তারের ফোনালাপ প্রকাশ্যে এসেছে বলে অভিযোগ। (যদিও সেই অডিয়ো ক্লিপের সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের মৃতদেহ যে ঘরে ছিল, সেখানে অভীক ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেই নিয়েও উঠেছিল প্রশ্ন। তার পরেই টান পড়েছিল সুতোয়। একে একে উঠে এসেছিল মেডিক্যাল কলেজে হুমকি সংস্কৃতি এবং ভয় দেখানোর অভিযোগ। উঠে এসেছিল ‘বর্ধমান শাখা’-র নাম, যার মাথা ছিলেন বিরূপাক্ষ।

আপাতত অভীক-বিরূপাক্ষদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা মনে করেন, ‘হুমকি সংস্কৃতি’র শিকড় আরও গভীরে। তার সঙ্গে জড়িত আরও অনেকে। সেই কারণেই তাঁরা চাইছেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে প্রশাসনের কড়া হস্তক্ষেপ। যাতে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা যায় সেই সংস্কৃতি।

অন্য বিষয়গুলি:

RG Kar Medical College and Hospital Incident threat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy