দুর্গাপুজোকে ‘মাধ্যম’ করে মমতা অনেক বেশি মানুষকে জড়িয়ে নিয়েছেন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজ্যের হাতে টাকা নেই। অথচ পুজোয় অনুদান ২৫৮ কোটি! সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুজো কমিটির জন্য অনুদান ঘোষণার পর থেকেই বিরোধীরা এক সুরে সরব। নেটমাধ্যম থেকে চায়ের দোকান— আলোচনা সর্বত্র।
কিন্তু ‘রাজনীতিক’ মমতা জানেন, এই আলোচনা বা সমালোচনা অল্প দিনের। পক্ষান্তরে, অনুদানের প্রতিদান দীর্ঘমেয়াদি। মায়ের পুজো ঘিরে অনুদানের আশীর্বাদ মেলে অনেক মানুষের কাছ থেকে। মজবুত হয় রাজনীতির মাটি। তাই এই প্রকল্পের আড়ালের আসল নাম ‘মা-মাটি-মানুষ’। এই ব্যাখ্যা কোনও অর্থনীতিবিদের নয়। এই ব্যাখ্যা এক পোড়খাওয়া রাজনীতিকের। বাম আমল থেকে তিনি শ্রীরামপুরের পুর প্রতিনিধি। নাম না-লেখার শর্তে তৃণমূলের ওই নেতা বলেন, ‘‘মমতা’দি রাজনীতির মাটি চেনেন। মানুষকেও চেনেন। তাই মায়ের পুজো ঘিরে তাঁর এই অভিনব ভাবনা। এর থেকে কেমন ‘ডিভিডেন্ড’ মেলে তা অর্থনীতিবিদরা বুঝবেন না। এটা বুঝতে গেলে পঞ্চায়েত বা ওয়ার্ড স্তরের রাজনীতি করতে হবে।’’
কেমন সেই ‘ডিভিডেন্ড’? ওই তৃণমূল নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘পুজোর অনুদান দিয়ে একটা ক্লাব বা কমিটিকে তৃণমূল কিনে নিচ্ছে তা নয়। আমাদের সমর্থক নয়, এমন অনেক কমিটিও টাকা পায়। সেই পুজোর সঙ্গে যুক্ত সকলেই সব নির্বাচনে ঘাসফুলে ভোট দেয়, এটাও জোরের সঙ্গে বলা যাবে না। কিন্তু স্থানীয় ভোটে প্রভাব পড়েই। বিশেষ করে মহিলা ভোট।’’ তবে ওই নেতার বক্তব্য, ‘‘আসল ফায়দা অন্য জায়গায়। ওই ক্লাব বা কমিটি তৃণমূলের দখলে না এলেও কোনও বিরোধী দলের আশ্রয় হতে পারে না। বরং, তৃণমূলের রক্তদান শিবির আয়োজনে সাহায্য করে।’’
কেন? ওই নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘আসলে সবাই ভয় পায়। কেউ ভয় না দেখালেও অভ্যাস একটা ভয় তৈরি করে। তৃণমূলকে অচ্ছুৎ করে অন্য দলের কাছে ঘেঁষলে যদি বারোয়ারির অনুদান বন্ধ হয়ে যায়! তার দায় নিতে চান না কেউ। কারও তেমন মনে হলেও বাধা দেয় সমষ্টি। তাই ক্লাবের স্বাধীনতা দিবসের পতাকা তুলতে ডাক পান তৃণমূল কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত সদস্য। স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে এগুলো খুব জরুরি।’’
ভোটের পাশাপাশিই এই অনুদান কোথাও একটা তৃণমূলের ‘কর্মীবাহিনী’ তৈরি করতেও সাহায্য করে বলে শাসক শিবিরের একাংশের দাবি। যেমন এ বছরের শেষের দিকে বা পরের বছরের প্রথম দিকে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে পারে। সেই ভোটে এই পুজো অনুদান ‘প্রভাব’ বিস্তার করবে বলে নেতাদের একাংশের বক্তব্য। তাঁরা উদাহরণ দিচ্ছেন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ‘জনকল্যাণমূলক’ প্রকল্পের। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের ‘জনমোহিনী’ প্রকল্প বছর বছর ভোটে তৃণমূলকে সাহায্য করেছে। এটি একটি ‘পরীক্ষিত সত্য’। যদিও প্রকাশ্যে কেউই তা স্বীকার করতে চান না।
সরকারি টাকা এ ভাবে পুজো কমিটিকে দেওয়ার বিরোধিতা করে ইতিমধ্যেই দু’টি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। প্রসঙ্গত, গত বছরও একই ভাবে মামলা হয়েছিল। তখন আদালতে সরকারের পক্ষে জানানো হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুজো কমিটিগুলি যাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য টাকা দেওয়া হচ্ছে। ফলে হিসাব জমা দেওয়ার সময়ে অনেক কমিটিকেই আলাদা করে মাস্ক, স্যানিটাইজার, ব্লিচিং পাউডারের বিল বানাতে হয়েছিল। করোনার প্রকোপ কমেছে। এ বার কী খাতে খরচ দেখানো, তা নিয়ে অনেক কমিটির কর্তারা চিন্তায়। তবে অনেকে আরও একটি আশঙ্কায় রয়েছেন— পুজোর অনুদান কি আদালতে বকেয়া মহার্ঘভাতা নিয়ে মামলার শুনানিতে সরকার পক্ষের যুক্তিকে ‘দুর্বল’ করে দিতে পারে? মামলার শুনানিতে যদি সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা বকেয়া থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি টাকা পুজোর অনুদান দেওয়ার কথা ওঠে? সে ক্ষেত্রে সরকার কী জবাব দেবে, তা নিয়ে উদ্বেগে প্রশাসনিক আধিকারিকদের একাংশ।
তবে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা আর পুজো অনুদানের মধ্যে তুলনা ঠিক নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘পুজোয় অনুদান দিতে ধরা যাক ২৫৮ কোটি টাকা খরচ হবে। এই টাকাটা কম নয়। কিন্তু রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এক বছর ১ শতাংশ মহার্ঘভাতা দিতে দরকার ৭১১ কোটি টাকা। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের পরে ২.৫৭ গুণ বেতন বেড়েছে। ফলে ১ শতাংশ মহার্ঘভাতা দেওয়াটাই অনেক টাকার বিষয়। বকেয়া মহার্ঘভাতার দাবি মেটাতে আরও অনেক টাকার প্রয়োজন।’’
প্রসঙ্গত, সিপিএম আমলেও তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে ক্লাবকে ফুটবল দেওয়া, ক্যারাম বোর্ড দেওয়া হত। কিন্তু দুর্গাপুজোকে ‘মাধ্যম’ করে মমতা অনেক বেশি মানুষকে জড়িয়ে নিয়েছেন। তৃণমূলের দাবি, কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি না নিয়েও বাংলায় এখন দুর্গাপুজো আর তৃণমূল সমার্থক হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণামতো রাজ্যের মোট ৪৩ হাজার পুজো কমিটিকে ৬০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। তাতে নবান্নের খরচ দাঁড়াবে ২৫৮ কোটি টাকা। যাকে ‘খয়রাতি’ বলে আখ্যা দিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘স্বশাসিত পুজো কমিটিগুলিকে সরকার-শাসিত করার চেষ্টা। রাজ্য সরকারের হাতে যখন কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘভাতা দেওয়ার অবস্থা নেই, তখন এত টাকা পুজোর জন্য দান করার কোনও মানেই হয় না।’’ প্রায় একই সুরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, ‘‘রাজ্যের উন্নয়নের জন্য টাকা নেই, টাকা নেই করলেও মেলা বা পুজোয় টাকা দেওয়ার সময় কোনও কার্পণ্য নেই। আসলে এটা ভোট কেনার রাস্তা।’’
যদিও তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘পুজো মানে শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়। এর সঙ্গে অর্থনীতিও যুক্ত। করোনা পরবর্তী সময়ে পুজো কমিটিগুলি খুবই চাপে ছিল। রাজ্যের অনুদানের ফলে মূর্তি বানানো থেকে প্যান্ডেল বানানোর শিল্পী এবং ঢাকিরা অর্থ পেয়েছেন।’’
মুখ্যমন্ত্রী যে ৪৩ হাজার পুজো কমিটিকে অনুদান দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন, তার বড় অংশই গ্রামাঞ্চল এবং মফস্সলের। সে সব এলাকায় পুজোর খরচ ৬০ হাজার টাকা মানে অনেক। কালনার বদ্যিপুরের কাছে একটি পুজো কমিটির দাবি, তাদের প্রতিমা ১০ হাজার টাকার। প্যান্ডেল ১৫ হাজার আর আলো ১০ হাজার টাকার। এর পরে বড় খরচ বলতে ঢাকি ছ’হাজার টাকা। প্রতিমা মণ্ডপে আনা এবং বিসর্জন বাবদ খরচ মোটামুটি তিন হাজার টাকা। ওই পুজো কমিটির সম্পাদক কল্যাণ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘এখন আর সে ভাবে চাঁদা তোলা হয় না। সরকারের অনুদানের টাকা, ক্লাবের ছেলেদের বৃত্তি, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাহায্য দিয়েই পুজো হয়ে যায়।’’ সরকারি অনুদান চালুর পরে দুর্গাপুজোর সংস্কৃতি বদলে গিয়েছে বলে মনে করেন উত্তরপাড়ার বাসিন্দা সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘এখন চাঁদা তোলার ছেলে পাওয়া যায় না। রাজ্য সরকারের অনুদান সময়ের দাবিও মিটিয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক সুবিধাও মেলে হয়তো। তবে হঠাৎ সরকার অনুদান বন্ধ করে দিলে সমস্যা হয়ে যাবে।’’
উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার একটি পুজো কমিটির সম্পাদক পার্থপ্রতিম সাহার বক্তব্য, ‘‘আমরা চাঁদা তুলি না। বাজেট লাখ টাকার উপরে। সরকারি অনুদান তো কাজে লাগেই। তবে তাতে রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি হয় বলে মনে হয় না।’’ কিন্তু সরকারি কোষাগারের টাকা কি অনুদান হিসাবে দেওয়া ঠিক? ওই বারোয়ারির সদস্য কাজল দাসের বক্তব্য, ‘‘আগে জোর করে মানুষের থেকে চাঁদা তোলা হত। সেটা এখন বন্ধ। পুজোয় সবাই আনন্দ করছে। সরকারও সবাইকে সমান চোখে দেখছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy