এঁরা টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ মানছেন না। ওঁরাও চাকরি হারিয়ে, সে টাকা ফেরত চাইতে পারছেন না।
রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রের চাকরি যাঁদের টাকা দিয়ে মিলেছিল, হয় তাঁরা জেলে, নয় বেপাত্তা, না হয় তেমন অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। আর ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের বন্ধনীতে যাঁরা পড়েন না, অথচ, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্কুলের চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের একাংশ টাকা নেওয়া লোকটিকে খুঁজে পাচ্ছেন না বা টাকা নেওয়া লোকটি ‘প্রভাবশালী’ বলে টাকা ফেরত চাইতে পারছেন না।
উত্তর ২৪ পরগনার বাগদায় টাকা নিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ায় অন্যতম অভিযুক্ত শক্তিগড় গ্রামের ‘সৎ রঞ্জন’ ওরফে চন্দন মণ্ডল। তার ‘হাতযশে’ স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন বাগদার অন্তত শতাধিক বাসিন্দা। টাকা তোলার জন্য চন্দনের একাধিক ‘এজেন্ট’ এলাকায় ছিল। নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআইয়ের হাতে ধরা পড়ে চন্দন এখনও হাজতে। সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরোনোর পর থেকে তাঁর ‘এজেন্টরাও’ গা-ঢাকা দিয়েছে। চাকরি হারানো এক শিক্ষকের বাবার প্রশ্ন, “কার কাছে টাকা চাইব!” সে জেলারই বারাসতের দুই শিক্ষক এবং এক শিক্ষাকর্মী বলেন, “যারা টাকা নিয়েছিল, তারা প্রভাবশালী। তাদের কাছে টাকা চাইতে পারছি না।” বাঁকুড়ায় যারা নিয়োগের জন্য টাকা নেওয়ায় অভিযুক্ত, হাই কোর্ট গত বছর চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার পরে, তাদের এক জনকে ফোন করেছিলেন বাঁকুড়া সদর মহকুমার এক শিক্ষাকর্মী। তাঁর অভিজ্ঞতা, “তখন আশ্বস্ত করেছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে। তার পরেই সে বেপাত্তা।” নিয়োগ দুর্নীতি-কাণ্ডে জামিন পাওয়া তৃণমূলের বহিষ্কৃত নেতা কুন্তল ঘোষের মুখে শোনা গিয়েছিল গোপাল দলপতির নাম। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর-২ ব্লকের খিরিশবাড়ি গ্রামের গোপাল দীর্ঘদিন বাড়িছাড়া।
রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ অতনু গুছাইতের হয়ে ঝাড়গ্রামে এক তৃণমূল কর্মীর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের জন্য টাকা তোলা হয়েছিল বলে খবর। পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের বাসিন্দা অতনু ওরফে কদমের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে। পুলিশের লুকআউট নোটিস জারির পরে, সপরিবার বেপাত্তা তিনি।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলের নদিয়া জেলা পরিদর্শক থাকাকালীন তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত ছিলেন নদিয়া জেলা পরিষদের তৎকালীন পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা হরিণঘাটার নেতা চঞ্চল দেবনাথ এবং দলের কল্যাণী শহর সভাপতি অরূপ মুখোপাধ্যায় ওরফে টিঙ্কু। প্রকাশ্যে তাঁদের নাম করে স্কুলে নিয়োগ-দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ করেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। কল্যাণীর বিজেপি বিধায়ক অম্বিকা রায় বুধবার বলেন, “এখন ওঁরাই বলুন, ওঁরা কি নির্দোষ?” দলের কোনও পদে না থাকা চঞ্চল বলেন, “ঘটনায় যুক্ত নই।” কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল অরূপ বলেন, “কোনও দুর্নীতির ক্ষেত্রে টাকা নিয়েছি, তা কেউ দেখাতে পারেনি।” শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন মুর্শিদাবাদের বড়ঞার বিধায়ক তৃণমূলের জীবনকৃষ্ণ সাহা। তাঁর দাবি, “দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।” তা হলে সিবিআই ধরল কেন? বিধায়কের জবাব, “মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, বিষয়টি বিচারাধীন।”
নিয়োগের জন্য টাকা নিয়েছেন, পূর্ব বর্ধমানে তৃণমূলের নানা নেতা-নেত্রীর দিকে এমন অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। সে মামলায় গত বছর হাই কোর্টের রায়ের পরে ওই সব নেতা-নেত্রীদের একাংশ প্রকাশ্যে বেশি আসা বন্ধ করে দেন। যে সব নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের নাম ‘অযোগ্য’ চাকরিহারারা প্রকাশ্যে আনতে নারাজ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)