বন্ধের জন্য মঙ্গলবার বহরমপুরের পুরাতন কান্দি বাসস্ট্যান্ডের বদলে গঙ্গার ধারে বসেছিল বাজার। সেখানেও হামলা চালান কংগ্রেস কর্মীরা। নষ্ট করেন আনাজপাতি। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
কোমর কষে নামার ঘোষণা ছিল রাজ্য প্রশাসনের। ‘কীসের বন্ধ’ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। তবু সপ্তাহের দ্বিতীয় কাজের দিনটিতে কার্যত বন্ধকেই জিতিয়ে দিলেন ছুটিপ্রিয় বাঙালি।
কেতুগ্রামে ছাত্রী ও সবংয়ে ছাত্র-হত্যা, গোটা রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বারো ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছিল কংগ্রেস। শাসক দল ধরে নিয়েছিল, রাজ্যে প্রায় ‘সাইনবোর্ড’-এ পরিণত হওয়া কংগ্রেসের ডাকা এই বন্ধে আদৌ সাড়া মিলবে না। বিরোধিতা না-করলেও বামেরা এই বন্ধকে উপেক্ষা করেছিল। নিজেদের শক্তির কথা ভেবে বন্ধের ‘সাফল্য’ নিয়ে খোদ কংগ্রেসের মধ্যেও সংশয় ছিল। তবু মেঘলা দিনে ছুটির আমেজ গায়ে মেখে বন্ধের ডাকেই যেন সাড়া দিল আম-বাঙালির একটা বড় অংশ। দিনের শেষে অনেকেরই অভিমত— কে ডাকছে সেটা বড় কথা নয়। এ রাজ্যে হরতাল-ধর্মঘটের যে কোনও ডাকই ‘স্বাগত’। বন্ধের দিন কাজের ডাকে সাড়া দিতে গড়পড়তা বাঙালির বয়েই গেছে।
ভোটবাক্সের নিরিখে যাই হোক, রাজনৈতিক শক্তির হিসাবে রাজ্যে কংগ্রেস অনেকটাই হীনবল। উত্তরবঙ্গের তিন জেলা জলপাইগুড়ি-মালদহ-উত্তর দিনাজপুর এবং দক্ষিণবঙ্গে মুর্শিদাবাদ এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশে কংগ্রেসের এখনও কিছু সংগঠন রয়েছে। রাজ্যের বাকি অংশে আক্ষরিক অর্থেই কংগ্রেসকে খুঁজে বেড়াতে হয়। তার ওপর পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছিল বন্ধের তারিখ ঘোষণা নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বনাম দলের একাংশের প্রকাশ্য বিরোধ। তবু ছুটির মজা লুটে কংগ্রেসকে ভাল নম্বর দিয়েই ‘পাশ’ করিয়ে দিল জনতা।
রায়গঞ্জে কংগ্রেস সমর্থকদের উপর আইএনটিটিইউসি সমর্থকদের হামলা চলার সময় যুবকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। ছবি: গৌর আচার্য।
প্রত্যাশিত ভাবেই বন্ধ নিয়ে শাসক দল ও কংগ্রেসের মধ্যে চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। বন্ধের বিরোধিতা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘বন্ধের নামে প্রহসন হচ্ছে। কোনও বন্ধ আমরা সমর্থন করি না। একটা বন্ধও মানা যায় না।’’ নজরুল মঞ্চে দলের কর্মীদের নিয়ে সভায় তাঁর পরামর্শ, ‘‘সবাইকে বলব, মাথা গরম করে নয়, শান্তিপূর্ণ ভাবে মানুষকে বোঝান। ধ্বংসাত্মক রাজনীতি নয়, গঠনমূলক ও মূল্যবোধের রাজনীতি হওয়া উচিত।’’ তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও কংগ্রেসের বন্ধের সমালোচনা করে ওই সভাতেই বলেন, ‘‘বন্যা নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর সে দিনই বন্ধ ডেকে বসল একটি সর্বভারতীয় দল! অবিবেচকের মতো বন্ধ ডেকে ছেলেখেলা করছে!’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর দাবি, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই কংগ্রেসকে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব বলে তাচ্ছিল্য করেন। অথচ বন্ধ ব্যর্থ করতে সরকারের গুন্ডা বাহিনী পুলিশকে রাস্তায় নামিয়েছেন তিনি। ফলে তৃণমূলের প্রতিপক্ষ হিসাবে তিনিই কংগ্রেসকে মেনে নিলেন।’’ সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, ‘‘যে সরকার কর্মচারীদের ৪৯% মহার্ঘ ভাতা বকেয়া রাখে, তারাই আবার বন্ধের দিন ফতোয়া জারি করে কোন মুখে? আসলে সরকার ভয় পেয়েছিল। নিজেদের যথাসাধ্য শক্তি নিয়ে কংগ্রেস ভালই বন্ধ করেছে, মানুষও সাড়া দিয়েছেন।’’
বন্ধ ব্যর্থ করতে কড়া বিবৃতি দিয়ে রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, সরকারি কর্মীরা কাজে না-এলে এক দিনের বেতন কাটা হবে এবং চাকরিজীবন থেকে ‘এক দিন’ কমে যাবে। সেই হুঁশিয়ারিতে নবান্ন-সহ কলকাতা ও সল্টলেকের বিভিন্ন সরকারি অফিসে হাজিরার হার ছিল প্রায় অন্য দিনের মতো। তবে বহু কর্মীই হাজিরা দিয়েছেন নির্দিষ্ঠ সময়ের অনেক পরে। আবার চলেও গিয়েছেন তাড়াতাড়ি। বন্ধ সত্ত্বেও যথারীতি কাজ হয়েছে সল্টলেকের তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে। তবে বিভিন্ন বেসরকারি অফিস খোলা থাকলেও সেখানে হাজিরা ছিল কম।
রাজ্য পরিবহণ দফতরের ঘোষণা মতো কলকাতায় সরকারি বাস-ট্রাম চলেছে অন্য দিনের মতো। তবে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন রুটে বেসরকারি বাস ও মিনিবাস চলেছে হাতে গোনা। ট্যাক্সির অবস্থাও ছিল তাই। শহরের ‘লাইফ লাইন’ চালু রাখতে সচল ছিল মেট্রো ও অটো। রেল সূত্রের খবর, মেট্রো চলেছে স্বাভাবিক ভাবেই। তবে ভরা অফিস টাইমেও অনেক আসন ছিল ফাঁকা। অটো-পরিষেবাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে অনেককেই বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে। বন্ধের কোনও প্রভাব পড়েনি কলকাতা বিমানবন্দরেও। তবে অনেক যাত্রীই ঝুঁকি এড়াতে খুব ভোরে অথবা সোমবার রাতেই বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
বন্ধে বাধা পেয়েছে রেল পরিষেবা। পূর্ব রেলের দাবি, তাদের শিয়ালদহ, হাওড়া, মালদহ, আসানসোল ডিভিশনে সকাল থেকে কিছু স্টেশনে বিক্ষিপ্ত ভাবে অবরোধ শুরু হওয়ায় ট্রেন চলাচল কিছুটা বিপর্যস্ত হয়। বেলা বাড়লে অবরোধ তুলে দেওয়ায় পরে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। শিয়ালদহ ডিভিশনে আট-জোড়া লোকাল ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে এবং ৩৪টি লোকাল ট্রেন অস্বাভাবিক দেরিতে চলাচল করেছে। তবে হাওড়ায় কোনও ট্রেনই বাতিল হয়নি। তবে কিছু ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি হয়েছে। একই চিত্র ছিল মালদহ ও আসানসোলে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দাবি, তাদের হাওড়া-খড়্গপুর শাখায় দাশনগর ও বাউড়িয়ায় দুই খেপে ৪০ মিনিট বিক্ষোভ হয়। তার পর রিক্ষোভ উঠলে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। অবরোধে দু’টি এক্সপ্রেস ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছতে দেরি হয়। সব মিলিয়ে কলকাতা শহর ও শহরতলির পরিবহণ ব্যবস্থা মোটের উপর চালু থাকলেও যাত্রীর সংখ্যা ছিল সামান্য। দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কংগ্রেস সভাপতি তাপস মজুমদারের নেতৃত্বে কিছু ক্ষণ রেল অবরোধ হলেও যাত্রীদের প্রতিরোধে তা উঠে যায়।
কলকাতা হাইকোর্টও এ দিন খোলা ছিল। সেখানে বিচারপতিরাও ছিলেন। তবু যথেষ্ট সংখ্যক আইনজীবীর অভাবে অধিকাংশ মামলারই উঠতে পারেনি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলি খোলা থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের হাজিরা বিশেষ চোখে পড়েনি। অনেক স্কুল অবশ্য অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আগেই ছুটি ঘোষণা করেছিল। বন্ধে বড়বাজার, বৌবাজার, রাজাবাজার-সহ বিভিন্ন এলাকার অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল। তবে বন্ধ ‘সফল’ করতে এ দিন কংগ্রেস কর্মীরা কোথাও কোথাও পথে নেমেছিলেন। কলকাতায় এ জন্য ২১৮ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
বন্ধ নিয়ে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি জেলায়। যেমন, নদিয়ার হরিহরপাড়া ব্লক অফিসে ভাঙচুর চালায় কিছু বন্ধ সমর্থক। বিডিও-কে নিগ্রহ করা হয় বলেও অভিযোগ। সবংয়ে যে সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ে ছাত্র খুনের প্রতিবাদে এই বন্ধের ডাক, সেখানেও সর্বাত্মক সাড়া পড়েছে। কলেজ খোলা থাকলেও ছাত্রছাত্রীরা আসেননি। তবে পশ্চিম মেদিনীপুরের বাকি এলাকায় বন্ধের তেমন প্রভাব পড়েনি। কংগ্রেসের তেমন সংগঠন না-থাকলেও ভাল বন্ধ হয়েছে শিলিগুড়িতে। মুর্শিদাবাদে বন্ধ হয়েছে সর্বাত্মক।
বন্ধ ব্যর্থ করতে শাসক দলকে প্রায় কোথাও না-দেখা গেলেও ব্যতিক্রম ছিল উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ। সেখানে আইএনটিটিইউসি-র লোক জন লাঠিসোটা হাতে কংগ্রেস কর্মীদের উপরে হামলা চালায়। তাঁদের কারও-কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলেও কংগ্রেসের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়। তৃণমূল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy