সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশনের অন্তর্বর্তী রিপোর্টকেই চূড়ান্ত ধরে নিয়ে বিধানসভায় পেশ করবে রাজ্য সরকার।
গত বছর অক্টোবর মাসের ২২ তারিখ এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়। ওই দিনই রাত দশটা পর্যন্ত অফিসে থেকে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন বিচারপতি সেন নিজে। কিন্তু সে দিন রাত হয়ে যাওয়ায় সেটি গ্রহণ করেনি নবান্নর কন্ট্রোল রুম। বলা হয়েছিল, পরে ক’দিন ছুটি রয়েছে। অফিস ফের খুললে ২৭ অক্টোবর রিপোর্টটি মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে পাঠানো হবে। এর পর ২৭ তারিখ অর্থ দফতরের প্রধান সচিব জানান, সরকার রিপোর্টটি গ্রহণ করবে না।
এ দিন, বুধবার রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তাও জানালেন, ওই রিপোর্টটি গৃহীত হচ্ছে না। কমিশনের অন্তর্বর্তী রিপোর্টকেই চূড়ান্ত রিপোর্ট বলে পেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র দফতরে ইতিমধ্যেই ওই রিপোর্ট নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী বিধানসভা অধিবেশনেই রিপোর্টটি পেশ করা যাবে।’’ রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে শ্যামলবাবুর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওঁরা যা ভাল বুঝেছেন, তাই করেছেন। আমি এ নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না।’’
সারদা কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়া এবং কেলেঙ্কারির তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিশন গড়েছিল রাজ্য। প্রথম বার মেয়াদ বৃদ্ধির পরে দ্বিতীয় দফার শেষে ফের মেয়াদ বাড়ানো হবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন কমিশনের কর্মীরা। কারণ সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের চেক দেওয়ার কাজ এবং অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থায় ক্ষতিগ্রস্তদেরও টাকা দেওয়া হবে কি না, তার শুনানি— কোনওটিই শেষ হয়নি। কিন্তু ইতিমধ্যে সিবিআই সারদা তদন্ত হাতে নেওয়ায় রাজ্য রাজনীতির আবহাওয়া বদলে যায়। এই পরিস্থিতিতে ২২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে রাজ্য সরকার আর তা বাড়ানোর ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেনি।
২২ অক্টোবর কমিশনের কার্যকালের শেষ দিনটিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করেন শ্যামলবাবু। কিন্তু কমিশনের অন্য দুই সদস্য অম্লান বসু এবং যোগেশ চট্টোপাধ্যায় সে দিন উপস্থিত ছিলেন না। ফলে চূড়ান্ত রিপোর্টে তাঁদের সই নেই। অম্লানবাবু নিজেই অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘ওটা শ্যামল সেনের ব্যক্তিগত রিপোর্ট। কমিশনের নয়। সরকারের ওই রিপোর্ট গ্রহণ করা উচিত নয়।’’ একে তো সব সদস্যের স্বাক্ষর নেই, তার উপরে রিপোর্ট জমা পড়েছে দেরিতে— এই কারণ দেখিয়ে ওই রিপোর্টকে চূড়ান্ত বলে গণ্য না করার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকারও। শ্যামলবাবুর স্বীকারোক্তি, ‘‘এটা সত্যি যে, রিপোর্ট জমা দিতে অনেক রাত হয়েছিল।’’ স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, সরকারি ভাবে কমিশনের রিপোর্ট বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে জমা নেওয়া চলে। ওই রিপোর্ট তার পরে জমা দেওয়া হয়েছিল। কার্যকাল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কোনও কমিশন কী ভাবে রিপোর্ট পেশ করে, প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। উপরন্তু স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘যে কোনও কমিশনের রিপোর্টে সব সদস্যের সই থাকা জরুরি। সেটা না-থাকলে স্বভাবতই রিপোর্ট গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’’ সব সদস্যের স্বাক্ষর না থাকলে রিপোর্ট যে গ্রাহ্য না-ও হতে পারে, সেই আশঙ্কা শ্যামলবাবুরও ছিল। কিন্তু তাঁর যুক্তি ছিল, মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। অন্য সদস্যেরা অনুপস্থিত থাকলে তাঁর কী-ই বা করার থাকে!
অন্তর্বর্তী রিপোর্টটি কী? শ্যামলবাবু এ দিন জানান, কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে একটি রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল কমিশন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সে সময়ের মধ্যে যা হয়েছিল, তাই লিখিত ভাবে রিপোর্টে জানানো হয়েছিল।’’ অর্থাৎ রিপোর্টটি যে অসম্পূর্ণ, তা শ্যামলবাবু নিজেই জানাচ্ছেন। তা হলে ওই রিপোর্টকে চূড়ান্ত বলে পেশ করবে কেন সরকার? বিরোধীদের অভিযোগ, সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার অভাবই এতে প্রমাণিত হচ্ছে।
বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘গোটাটাই যে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে একটা গিমিক ছাড়া কিছু নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছে।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘ক্ষতিগ্রস্তরা সকলে চেক পাননি। চেক দেওয়া নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে। চূড়ান্ত রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়ে সেই তথ্যগুলোই আড়াল করা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy