Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

খুনের মামলায় বেকসুর, ২৮টা বছর ফেরাবে কে?

বাস্তব রুপোলি পর্দার চেয়ে অনেক কঠিন। সেই বাস্তবের শেখ জাহাঙ্গির খান খুনের মামলায় ২৮ বছর জেল খেটে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। পর্দার ছবি বিশ্বাস অভিনীত চরিত্রটিকে মুক্ত করেছিলেন উত্তম কুমার অভিনীত এক আইনজীবী-চরিত্র।

শমীক ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৮ ০২:৫৩
Share: Save:

বিনা অপরাধে এক যুগ কারাগারে কাটানোর পরে বেকসুর খালাস পেয়ে জীবনের বারোটা বছর হারিয়ে ফেলার হাহাকার কেমন হতে পারে, ‘সবার উপরে’ ছবিতে ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ে তা অমর হয়ে আছে।

বাস্তব রুপোলি পর্দার চেয়ে অনেক কঠিন। সেই বাস্তবের শেখ জাহাঙ্গির খান খুনের মামলায় ২৮ বছর জেল খেটে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। পর্দার ছবি বিশ্বাস অভিনীত চরিত্রটিকে মুক্ত করেছিলেন উত্তম কুমার অভিনীত এক আইনজীবী-চরিত্র। জাহাঙ্গির মুক্তি পেলেন এক আদালত-বান্ধব কৌঁসুলির তৎপরতায়। সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ সিউড়ি আদালতের রায়কে খারিজ করে মহম্মদবাজার থানা এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গিরকে বেকসুর মুক্তি দিয়েছে।

পুলিশ জানায়, ১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর বিকেলে মহম্মদবাজার থানার দোলকাটা গ্রাম সংলগ্ন একটি খাদানের কুয়োয় জাহাঙ্গিরকে পাথর ফেলতে দেখে এলাকার বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়। তাঁরা কুয়ো থেকে জল আনতে গিয়েছিলেন। বাসিন্দারা জানতে চান, জাহাঙ্গির পাথর ফেলছেন কেন? ওই ব্যক্তি জানান, মাছ ধরার জন্য পাথর ফেলছেন। বাসিন্দাদের সন্দেহ বাড়ে। তাঁরা জাহাঙ্গিরকে আটকে রেখে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে জল তুলে ফেলার পরে দেখেন, নলিকাটা অবস্থায় এক তরুণীর দেহ পড়ে আছে কুয়োর তলায়। চৌকিদার সব দেখে পুলিশ ডেকে আনেন। এক বৃদ্ধা পুলিশকে জানান, মৃতদেহটি তাঁর মেয়ে ছবি মুর্মুর। দিন দুয়েক আগে দোলকাটা ঘাটে যাবে বলে বেরিয়েছিলেন ছবি।

আরও পড়ুন: একটানা কর্মবিরতি, জেরবার আমজনতা

লাগাতার জেরার পরে পুলিশ জানায়, জাহাঙ্গির স্বীকার করেছেন, তাঁর শ্যালিকা মেহেরুন বিবির স্বামী ফরাজের সঙ্গে ছবির অবৈধ সম্পর্ক ছিল। সেই জন্য মেহরুন বিবি ও শ্বশুর সালেম শেখকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাঁশবাগানে হাঁসুয়া দিয়ে তিনি ছবিকে খুন করেছেন এবং পরে তিন জনে মিলে দেহ কুয়োয় ফেলে দিয়েছেন। জাহাঙ্গির ও মেহেরুনকে গ্রেফতার করা হয়। সালেম পলাতক।

সিউড়ি আদালত ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই জাহাঙ্গিরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের অভাবে মেহেরুনকে মুক্তি দেওয়া হয়। জাহাঙ্গির হাইকোর্টে আপিল করেন। দীর্ঘদিন পরে সম্প্রতি ওই মামলা ওঠে বিচারপতি বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে। জাহাঙ্গিরের পক্ষে কোনও আইনজীবী না-থাকায় বিচারপতি বাগচী সরকারি প্যানেলভুক্ত আইনজীবী অরুণ মাইতিকে আদালত-বান্ধব হয়ে ওই ব্যক্তির মামলা লড়ার নির্দেশ দেন।

সরকারি কৌঁসুলি জারিন খান হাইকোর্টে জানান, দণ্ডিত ব্যক্তি তো নিজেই অপরাধ স্বীকার করেছেন। এটাই যথেষ্ট। নিম্ন আদালত এ ক্ষেত্রে যথাযথ শাস্তিই দিয়েছে।

অরুণবাবু জানান, তাঁর মক্কেল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন পুলিশের চাপে, ভয় পেয়ে। তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণে বিভিন্ন ফাঁকফোকরের উল্লেখ করে ওই আদালত-বান্ধব কৌঁসুলি বলেন, পুলিশ জাহাঙ্গিরকে গ্রেফতার করার অনেক পরে খুনে ব্যবহৃত হাঁসুয়া উদ্ধার করলেও তার ফরেন্সিক পরীক্ষা করানো হয়নি। তা ছাড়া পুলিশ এমন কোনও সাক্ষী বা প্রমাণ নিম্ন আদালতে পেশ করতে পারেনি, যা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে, ফরাজের সঙ্গে ছবির সম্পর্ক ছিল। জাহাঙ্গিরের সঙ্গে ছবিকে ঘটনার আগে-পরে কেউ দেখেওনি। গোটা ঘটনা পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। অথচ যিনি প্রথমে ঘটনাস্থলে গিয়ে সব দেখে থানার পুলিশকে ডেকে আনেন, সেই চৌকিদারকেই সাক্ষী করা হয়নি। এমনকী মামলার চার্জশিটে তাঁর নাম পর্যন্ত নেই।

দু’পক্ষের সওয়ালের পরে ডিভিশন বেঞ্চ জাহাঙ্গিরকে বেকসুর ঘোষণা করে মুক্তির নির্দেশ দেয়। প্রায় আড়াই যুগ পরে জাহাঙ্গিরের গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর পরিবারের কেউ সেখানে নেই। কোথায় গিয়েছেন, পড়শিরা তা জানাতে পারেননি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE