Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

শতবর্ষের ইস্কো নিজেই ইতিহাস

বর্তমানে ‘ইস্কো’ একটি কারখানা  নয়, নিজেই একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস প্রতি পদে প্রভাবিত করেছে বার্নপুরের জনজীবনকে। কেমন ছিল শতবর্ষের পথ চলা? ফিরে যাওয়া যাক একশো বছর আগে।

বার্নপুরের ইস্কো কারখানার প্রবেশপথ। ছবি: নিজস্ব চিত্র

বার্নপুরের ইস্কো কারখানার প্রবেশপথ। ছবি: নিজস্ব চিত্র

শ্যামল হোমরায়
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০১:৪৪
Share: Save:

স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘ইস্কো’ (ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি) স্থাপন করেছিলেন ১১ মার্চ, ১৯১৮ সালে। এ বছর শতবর্ষে পা দিল এই প্রতিষ্ঠান। ‘ইস্কো’র সঙ্গে গড়ে উঠেছিল আরও কিছু কারখানা। কালক্রমে তাদের বেশির ভাগই ‘ইস্কো’র সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বার্নপুরের নানা গঠনমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়েছে ‘ইস্কো’, বিশেষত স্যর রাজেন্দ্রনাথ এবং তাঁর পুত্র স্যর বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নাম। বর্তমানে ‘ইস্কো’ একটি কারখানা নয়, নিজেই একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস প্রতি পদে প্রভাবিত করেছে বার্নপুরের জনজীবনকে। কেমন ছিল শতবর্ষের পথ চলা? ফিরে যাওয়া যাক একশো বছর আগে।

সময়টা ১৯১৮ সালের ১৫ অক্টোবর। ‘মার্টিন বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি’ এবং স্যর রাজেন্দ্রনাথের উদ্যোগে বার্নপুরে একেবারে ‘ইস্কো’র গা ঘেঁষে গড়ে উঠল আরও একটি কারখানা— ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন কোম্পানি’ সংক্ষেপে ‘বি এস কোং’। ইস্কোর সঙ্গে অন্য সম্পর্কও ছিল ওই সংস্থার। এক সময়ে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন কোম্পানি’-র এক উচ্চপদস্থ কর্তা অশোক অধিকারী ছিলেন স্যর রাজেন্দ্রনাথের পুত্র স্যর বীরেন্দ্রনাথের শ্যালক।

‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন কোম্পানি লিমিটেড’ রেজিস্ট্রি হয়েছিল নন গভর্নমেন্ট কোম্পানি হিসেবে। প্রথম দিকে এখানে রেলের ওয়াগন তৈরি হতো। ১৯৭৬ সালে জাতীয়করণের পরে, কোম্পানিটি ‘বার্ন স্ট্যান্ডার্ড’ কোম্পানির সঙ্গে মিশে যায়। এর নতুন নাম হয় ‘বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি লিমিটেড’। বর্তমানে বার্নপুরের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন কোম্পানি’, তার সঙ্গে যুক্ত ‘মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি’ ও স্যর রাজেন্দ্রনাথকে প্রায় ভুলতে বসেছেন। আজ ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন কোম্পানি’-র সীমানায় আছে একটি পরিত্যক্ত বাংলো, যার সদর দরজায় লেখা আছে ‘মার্টিন বার্ন লিমিটেড’।

১৯৩২ সালে জেএন বর্মন, জেকে বসু প্রমুখের উদ্যোগে ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় বার্নপুর গার্লস স্কুল তৈরি হয়েছিল। স্কুল স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন স্যর বীরেন্দ্রনাথ ও ‘ইস্কো’ কর্তৃপক্ষ। ১৯৮২ সালে স্কুলটি নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়। স্কুলের আদি ভবনে বর্তমানে তৈরি হয়েছে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-আবাস।

১৯৬০ সালের ২৪ মার্চ স্যর বীরেনের পত্নী লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তৈরি হয় ‘মহিলা মঙ্গল সভা’। ভারতী ভবনের বিপরীতে ‘ইস্কো’র একটি নবনির্মিত ভবনে তার কার্যালয় গড়ে ওঠে। মহিলাদের স্বনির্ভরতার নানা পাঠ দেওয়া হতো এই সভার উদ্যোগে। সেই ভবনটির অপর অংশে চলত ‘ইস্কো’র কর্মীদের প্রশিক্ষণ।

স্যর রাজেন্দ্রনাথ কর্মচারীদের সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলি খেয়াল রাখতেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ‘ইস্কো’-কর্মীদের থাকার জন্য বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময়েই দামোদরের ধারে ছায়া ঘেরা পরিবেশে রিজ্ রোড এবং পার্ক অ্যাভিনিউয়ের সুবিশাল বাংলোগুলি নির্মিত হয়েছিল। প্রথম দিকে স্যর রাজেন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীকালে স্যর বীরেন্দ্রনাথ বার্নপুরে এলে ৭ নম্বর রিজ্ রোডের বাংলোয় উঠতেন। বর্তমানে সেটি সিইও-র কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। রিজ্ রোডের বিভিন্ন প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকতেন কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীরা।

‘ইস্কো’র কর্মীদের পানীয় জল সরবরাহের জন্য জলবণ্টন প্রকল্প গড়েছিলেন স্যর রাজেন। এই কাজের জন্য দামোদরের তীরে একটি পাম্পহাউস এবং শহরের মধ্যস্থলে ‘টাউন অফিস’ তৈরি করা হয়। সেই ‘টাউন অফিস’ই আজকের ‘টাউন ডিপার্টমেন্ট’। স্যর রাজেন্দ্রনাথের তৈরি জলপ্রকল্পে নদের জল তুলে প্রথমে রাখা হতো একটি বিরাট জলাশয়ে। এর নাম ছিল ‘প্রি সেটলিং ট্যাঙ্ক’। সেখানে চলত জল পরিশোধনের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ। দ্বিতীয় ধাপের শুদ্ধিকরণের জন্য সেখান থেকে জল আনা হতো ‘টাউন ডিপার্টমেন্ট’-এর দু’টি ‘সেটলিং ট্যাঙ্ক’-এ। তার পরে সেই জলকে ক্রমপর্যায়ে সাতটি ‘স্লো ফিল্টার বেড’-এর মধ্যে দিয়ে পরিশুদ্ধ করে তা সরবরাহের উপযুক্ত করে তোলা হত। এই ‘প্রি সেটলিং ট্যাঙ্ক’ এখনও রয়েছে। বর্তমানে সেখানে শীতকালে নানা পরিযায়ী পাখিরা আসে।

কলকাতা থেকে সরাসরি বার্নপুরে যাতায়াতের জন্য স্যর বীরেন কালাঝরিয়া ‘এয়ারস্ট্রিপ’ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেটি তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে এটিকে বিমান বন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। আশা করা যায়, এটি চালু হলে বার্নপুরের আর্থিক উন্নতিতে নতুন জোয়ার আসবে।

‘ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’কে বলা হতো ‘হিরাপুর ওয়ার্কস’ এবং ‘স্টিল কর্পোরেশন অব বেঙ্গল’ (স্কব)-কে বলা হতো ‘নেপুরিয়া ওয়ার্কস’। হিরাপুর নামক জনপদটি আজও রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী কালে ‘স্টিল কর্পোরেশন অব বেঙ্গল’ ‘ইস্কো’র সঙ্গে মিশে যাওয়ার ফলে ‘নেপুরিয়া ওয়ার্কস’ নামটি বিলুপ্ত হয়। অনেকে হয়তো জানেন না, সাঁতা সংলগ্ন অঞ্চলে নেপুরিয়া বা নুপুরা নামে একটি জনপদ ছিল। ‘ইস্কো’র ইতিহাসে পঞ্চকোট রাজ পরিবারের কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয়। তাঁরা প্রায় ১৯০০ বছর মানভূমে রাজত্ব করেছিলেন। এই রাজবংশ কল্যাণেশ্বরী, আসানসোল, হিরাপুর গড় পঞ্চকোট-সহ ২২টি জনপদ স্থাপন করেছিল। ‘ইস্কো’র ইতিহাসে এই তথ্য অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, বরাকর, কল্যাণেশ্বরী, হিরাপুর-সহ যে অঞ্চল পঞ্চকোটের রাজাদের অধীনস্থ ছিল, সেখানেই ‘ইস্কো’র কারখানাটি গড়ে উঠেছিল। অতীতে বার্নপুরে ‘বেবি শো’, ‘ফ্লাওয়ার শো’, ‘ডগ শো’-র আয়োজন করা হত ‘ইস্কো’র ক্রিকেট মাঠে। বর্তমানে এমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

বর্তমানে স্যর রাজেনের নামাঙ্কিত একটি মুক্ত মঞ্চ আছে ভারতী ভবনে। বার্নপুর রেল স্টেশনের কাছে গড়ে ওঠা পার্কে স্যর বীরেনের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। এ রকম কিছু উদ্যোগ থাকলেও কার্যত তা বিক্ষিপ্ত বলে মনে‌ হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে বাদ দিলে আজকের বার্নপুর প্রায় ভুলতে বসেছে ‘ইস্কো’র প্রতিষ্ঠালগ্নের ইতিহাসকে।

লেখক প্রাক্তন ইস্কো কর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

IISCO Steel Plant IISCO Steel Plant
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE