সাগর ঘোষের স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ ও হৃদয়। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
সাগর ঘোষের হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত কেউ তৃণমূলের সদস্য ছিল না— আদালতের রায় ঘোষণার পর এমনই দাবি করলেন নিহতের ছেলে হৃদয় ঘোষ। বৃহস্পতিবার তাঁর মন্তব্য, ‘‘ওরা তখন দলের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছিল।’’
২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে গুলিতে খুন হন পাড়ুইয়ের বাঁধনবগ্রামের বাসিন্দা সাগরচন্দ্র ঘোষ। নিহতের পরিবারের অভিযোগ ছিল, এর পিছনে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মদত রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার নালিশ জানিয়ে সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নিহতের পরিবার।
হাইকোর্টের নির্দেশে মামলার তদন্তভার নেয় বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই সিট আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। তাতে নাম ছিল তৃণমূলের অঞ্চল কমিটির সম্পাদক শেখ মুস্তফা, তৃণমূলের কসবা অঞ্চল সভাপতি শেখ ইউনুস, জলধর দাস, জগন্নাথ দাস, প্রিয় মুখোপাধ্যায়, ভগীরথ ঘোষ, সুব্রত রায় এবং শেখ আসগরের।
তখন চলছে মামলার রায়দান। জেলা আদালতে বিশেষ নিরাপত্তা। নিজস্ব চিত্র
সিউড়ি জেলা আদালতে ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি চার্জ গঠিত হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শুরু হয় সিউড়ির তৎকালীন জেলা জজ গৌতম সেনগুপ্তের এজলাসে। কিন্তু ওই চার্জশিটে সন্তুষ্ট ছিলেন না নিহতের পরিবার। সাগর ঘোষের স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ, ছেলে হৃদয় ঘোষ, পুত্রবধূ শিবানী ঘোষ মামলার সাক্ষ্য দিতে এক দিনও আদালতে হাজির হননি। তাঁরা সিবিআই তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে নিম্ন আদালতে ওই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। পরে অবশ্য নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেন নিহতের ছেলে হৃদয় ঘোষ। সুপ্রিম কোর্টে মামলা প্রত্যাহার করেন তিনি। নিম্ন আদালতে ফের শুরু হয় সেই মামলা।
গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই বদলেছে। সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডে তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল সহ ওই দলের কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন হৃদয় ঘোষ ও তাঁর পরিবার।
সাগর ঘোষ হত্যা মামলা
২০১৩
• ১৭ জুলাই: নির্দল প্রার্থীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ‘হুমকি’ অনুব্রত মণ্ডলের।
• ২১ জুলাই: পাড়ুইয়ের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাড়িতে হামলা। গুলিবিদ্ধ বাবা সাগর ঘোষ।
• ২৩ জুলাই: বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে সাগর ঘোষের মৃত্যু।
• ২৪ জুলাই: বীরভূমের এসপি-র কাছে অনুব্রত-সহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ।
• ২৫ জুলাই: উস্কানিমূলক মন্তব্যে পুলিশকে সঠিক ভাবে অনুব্রতের বিরুদ্ধে মামলা শুরুর নির্দেশ।
• ৫ অগস্ট: কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হৃদয় ঘোষ।
• ২৩ ডিসেম্বর: মামলার তদন্তভার সিআইডির হাতে।
২০১৪
• ১৫ ফেব্রুয়ারি: হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার ডিজি নেতৃত্বাধীন বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) হাতে।
• ১৬ জুলাই: সিউড়ি আদালতে চার্জশিট। নাম ছিল না অনুব্রতর।
• ৪ সেপ্টেম্বর: হাইকোর্টে হাজিরা ডিজি জিএমপি রেড্ডির। জানালেন, ওই ঘটনায় অনুব্রত মণ্ডলের কোনও প্রভাব ছিল না।
• ২৪ সেপ্টেম্বর: মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দিল হাইকোর্ট।
• ৩ ডিসেম্বর: সিবিআই তদন্তের সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশ খারিজ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের।
• ২১ ডিসেম্বর: সিবিআই তদন্তের আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে নিহতের পরিবার।
২০১৫
• ৪ জানুয়ারি: সিটের চার্জশিটের ভিত্তিতে সিউড়ি জেলা আদালতে চার্জ গঠন।
• ৯ ফেব্রুয়ারি: সিটের তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করে সাক্ষ্যদানে অনুপস্থিত নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
• ২৭ ফেব্রুয়ারি: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নিম্ন আদালতে মামলায় বিচার প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ।
• ৭ অগস্ট: সুপ্রিম কোর্টে মামলা প্রত্যাহার হৃদয় ঘোষের।
২০১৬
• ১৫ জানুয়ারি: ফের বিচার প্রক্রিয়া শুরু।
২০১৮
• ২৭ মার্চ: শেষ হয় মামলার সাক্ষ্যদান পর্ব।
• ২৬ এপ্রিল: আট অভিযুক্তের মধ্যে দোষী সাব্যস্ত দু’জন।
এখন পরিস্থিতি বদলেছে ১৮০ ডিগ্রি। প্রথম দিন থেকেই অভিযুক্তেরা দাবি করেছিলেন, তাঁরা নির্দোষ। বেকসুর খালাস হওয়ার পর শেখ মুস্তফা, প্রিয় মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মুস্তফার স্ত্রী শুকরুনা বিবি, প্রিয়বাবুর স্ত্রী অপু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অকারণে সকলের এত বছর নষ্ট করে দিল হৃদয় ঘোষেরা।’’ শেখ ইউনুস বলেন, ‘‘পুরো মিথ্যা মামলা। বাকি দু’জন মুক্তি পেলে আরও ভাল লাগত।’’
ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি দোষী সুব্রত রায়ের দাদা অপু রায়, ভগীরথ ঘোষের দাদা সঙ্কুজিৎ ঘোষ। তাঁরা বলছেন, ‘‘অন্যায় হল ওদের সঙ্গে। গত নির্বাচনে ওরা তৃণমূলের কর্মী হওয়ায় হৃদয়রা ফাঁসিয়ে দিয়েছে। সবাই নির্দোষ। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।’’ হৃদয় ঘোষ তো এ বার তৃণমূলের টিকিটে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী? তাঁদের জবাব, ‘‘ওটা দলের সিদ্ধান্ত। তবে এখনও তৃণমূলই করি।’’
সিউড়ি আদালত চত্বরে এ দিন কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি রুখতে মোতায়েন ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy