সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সুমি (মাঝে)। নিজস্ব চিত্র।
ভোরের আলো ফুটতেই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ।‘‘দি ওঠ, দি ওঠ, আমার প্যাটে কিসু নাইরে...’ ধড়মড়িয়ে ওঠেন সুমি দাস। লকডাউনের সময় এমন রাত-ভোরের কড়ানাড়ায় অভ্যস্ত তিনি। অঝোরে কাঁদতে থাকেন রাজবংশী শেমলি! একে রূপান্তরকামী, তায় ভাল করে কথা বলতে পারেন না। এই লকডাউনে কেউ এক মুঠো চাল দিয়ে সাহায্য করেনি তাঁকে। শেষ সম্বল সুমিদি।
“আমরা নারী,পুরুষ নই। যেন সামাজিক জন্তু! রেশন আনতে গিয়ে এখন কোচবিহার অঞ্চলে শুধু ডিজিটাল রেশন কার্ড নেই বলে বেশিরভাগ রূপান্তরকামীকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।” ক্ষোভ উগরে দিলেন সুমি, উত্তরবঙ্গের রূপান্তরকামী লড়াইয়ের অন্যতম মুখ তিনি। মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় ১৪ বছরেই ঘরছাড়া সুমি।“বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার পর সেক্স ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করেছি বহুদিন।পেটের জ্বালা খুব চিনি। লকডাউনের চেয়েও খারাপ সময় কাটিয়েছি।লোকে ছিঁড়ে খেত আমায়!দিন গেল। ফিরলাম গ্রামে।” সুমির মনে হয়েছিল, গ্রামে রূপান্তরকামীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। সবাই একঘরে। টিটকিরি আর কৌতুকের খোরাক। বাসা বাঁধলেন সুমি এই মানুষদের নিয়ে।“এখানে কেউ হিজড়েবৃত্তি করে, কেউ শীতলপাটির কাজ শিখে মেলায় বিক্রি করে, কেউ বিহারে যায় শাদি বিয়েতে গান নাচ করে।কেউ যাত্রা করে। কেউ বা ট্রেনে টাকা তোলে।” বলছিলেন সুমি। সোমবার সকালেই গ্রাম থেকে ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে চল্লিশজন মানুষকে চাল, ডাল, আটা, আলু তুলে দিয়েছেন। “অন্তত কয়েকটা দিন যাবে।লকডাউন তো বেড়েই চলেছে...” নিঃশ্বাস গাঢ় হচ্ছে সুমির।
সরকারি ত্রাণ?
“কিছু পেয়েছি মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের মাধ্যমে মন্ত্রী শশী পাঁজার কাছে আবেদন করে। তবে আমাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি তো রেশন কার্ড নেই। কী দেখাবে?কী খাবে?” রাতে ঘুম নেই সুমির। তাঁর ‘মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি’ সপ্তাহে ২-৩ বার কমিউনিটি ক্যান্টিন তৈরি করছে। কিন্তু তাতে ডাল, সয়াবিন আর ভাত দিয়ে দুপুরের বুভুক্ষু পেটের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। বাকিটা কী হবে কেউ জানে না!
আরও পড়ুন- কলকাতা-সহ ৭ জেলার অবস্থা গুরুতর, রাজ্যে আসছে কেন্দ্রীয় দল
"আমরা নারী-পুরুষ নই, যেন সামাজিক জন্তু!"
জাপান যেমন শুধু নিজের নয়, বাবা-মাকে কী খেতে দেবে বুঝতে পারছেন না আর। “আমি রূপান্তরকামী, তায় সেক্স ওয়ার্কার। গ্রামের লোকের অশ্রদ্ধা,ঘেন্না সব মেনে নিয়েও নিজের কাজ করে সংসারের পেট ভরাতাম। এই করোনা এসে সব বন্ধ করে দিল। ছোঁয়াচে রোগ, কেউ আর ঘরে ডাকছে না। হাতই মেলাচ্ছে না, তো শরীর! আমরা করোনায় নয়, না খেয়ে মরব,” ক্ষোভ উগরে দিলেন জাপান।সুমির মৈত্রী সঙ্ঘের চাল, ডাল আর আলু নিয়ে আজ তিনি ঘরে ফিরছেন।
আর সুমি? ভয় বলে কিছু নেই তাঁর। নিয়মিত ফেসবুকে রূপান্তুরকামীদের জন্য টাকা চাইছেন।সুমি ফেসবুকে লিখেছেন,“গতকাল রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে ৩টে বেজে গিয়েছে। সকাল ৯টায় পুরো বক্তব্যতে একটাও কাজের কথা নেই...প্লিজ মোমবাতি কিনে টাকা নষ্ট করবেন না। সেই টাকা আমাদের পাঠান।”
আর এক রূপান্তরকামী ঈশ্বর কোনও দিন হিজড়েবৃত্তি বেছে নেননি। তিনি ট্রান্স শীতলপাটি কর্মী। তাঁর দলে চারজন ট্রান্স মানুষ শীতল পাটি বানান।“এমনিতেই এই শীতলপাটির কাজ করতে গিয়ে নানা বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়, যেহেতু এই মার্কেট পুরুষ প্রধান। এখন কোনও মেলা নেই, হাট নেই, কোথায় যে সব বিক্রি হবে?আগে সপ্তাহে ৩০০-৪০০ টাকা জুটে যেত। এখন সব বন্ধ। খাব কী? ঘাস?” বিপর্যস্ত ঈশ্বর।
আরও পড়ুন: লকডাউনের শর্ত মানছে না অনেক রাজ্য, কড়া চিঠি পাঠাল কেন্দ্র
লোকাল ট্রেনে লোকমুখের গঞ্জনা শুনে ভিক্ষে করে খায় শেমলি। “ট্রেন বন্ধ। তিন দিন খাইনি কিছুই। সুমিদি ভাত দিল।এ বার কোথায় যাব? জানি না। বাড়ির লোক বসে খেতে দেবে না। ওরা পয়সা চায়।মনে হয় আত্মহত্যাই করব...,” গলা ধরে আসে শেমলির।বার বার মনে হচ্ছে তাঁর, লোকাল ট্রেনে ভিক্ষে না করে এক্সপ্রেস ট্রেনে ভিক্ষে করলে হয়তো নিজের জন্য কিছু সঞ্চয় করতে পারতেন,বুঝিয়ে দিলেন শেমলি, “এক্সপ্রেসের রেট অনেক বেশি।”
ছোঁয়াচ রোগ, মহামারি— এসব আর মাথায় নেই...
সম্প্রতি পায়েল এসেছেন সুমির কাছে।বললেন, “বিহারে নাচতে যেতাম আমি। বিহারিদের বিয়েতে আমাদের মতো মানুষের নাচের চল খুব। পয়সাও ভাল দিত ওরা।এই লকডাউনে সে সব বন্ধ! মালিক যে টাকা দিয়ে বায়না করেছিল সেটাও ফেরত দিতে হয়েছে। সুমিদি আর কত টানবে?” প্রশ্ন পায়েলের।
সুমি হাইপার টেনশনের রোগী।বুঝে উঠতে পারছেন না, ৩ মে-র পরে তাঁর আশ্রয়ে আসা প্রায় ৪০ জন মানুষের পেটের জ্বালা কেমন করে মেটাবেন?
আরও পড়ুন: করোনা-টেস্টের নিম্নমানের কিট, অভিযোগ রাজ্যের, দায় বাইপাস করল নাইসেড
সামনে অন্ধকার পথ। কাল ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়বেন পথে। ছোঁয়াচ রোগ, মহামারি— এসব তাঁর আর মাথায় নেই। “মাথাভাঙার একটা গ্রামে ২৫ জন হিজড়ে যারা বাজনা বাজায় তারা খেতে পাচ্ছে না। ফোন করছে ওরা আমায়। আমায় যেতে হবে।আমাদের আত্মীয় নেই। বন্ধু নেই। কিচ্ছু নেই।আমাদের কমিউনিটিকে আমাদেরই দেখতে হবে। ওরা বাঁচলে আমিও বাঁচব।”
কোচবিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরজায় হাজির মারণরোগ করোনা। এরই মাঝে পথে পথে ঘুরছেন সুমি, মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বিতাড়িত নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে বড় হয়ে ওঠা এক ‘মানুষ’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy