লোকসানে ধুঁকছে রাজ্যে বিদেশি লগ্নির প্রধান মুখ। বাঁচার পথ খুঁজতে দ্বারস্থ হয়েছে বিআইএফআর-এর (বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন বা শিল্প ও আর্থিক পুনর্গঠন বোর্ড)। তার পর চোদ্দো মাসেও বৃহত্তম এই বিদেশি বিনিয়োগকে বাঁচাতে সরকার কোনও পদক্ষেপই করেনি। উল্টে প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন, এমন অভিযোগ নবান্নের অন্দরেই।
শিল্পায়নের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মনোভাব কী, সেটা হলদিয়ার মিৎসুবিশি কেমিক্যালসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। লোকসানের বোঝা মোট সম্পদের বেশি হয়ে যাওয়ার পরে গত বছর অগস্টে বিআইএফআর-এর দ্বারস্থ হয় সংস্থাটি। অথচ রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীর দাবি, এখনও তিনি বিষয়টি জানেন না! শিল্পমন্ত্রী জানেন কি? ফোনে, এসএমএসে তাঁর অবশ্য সাড়া মেলেনি।
শিল্পশহর হলদিয়ায় প্রথম বিদেশি লগ্নি এসেছিল মিৎসুবিশির হাত ধরেই। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের পরে এ রাজ্যে সব চেয়ে বেশি বিনিয়োগ এই সংস্থারই। ২০০০ সালে কারখানার পত্তন হওয়া থেকে এ পর্যন্ত দু’দফায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লগ্নি করেছে জাপানি বহুজাতিক সংস্থাটি। ২০০২ সাল থেকে শুরু হয় পিউরিফাইড টেরিপথ্যালিক অ্যাসিডের (পিটিএ) বাণিজ্যিক উৎপাদন। ২০১০ সালে হলদিয়াতেই দ্বিতীয় কারখানা তৈরি করে মিৎসুবিশি।
কিন্তু সম্প্রসারণের তিন বছরের মাথাতেই কেন লোকসানের খাতায় নাম লেখাল সংস্থাটি?
সংস্থা সূত্রের খবর, গত বছরের গোড়ার দিকেই সমস্যার সূত্রপাত। যার মূল কারণ চিনে তৈরি কম দামের পিটিএ-তে বাজার ছেয়ে যাওয়া। সেই পিটিএ ভারতেও আসছে। মিৎসুবিশির পিটিএ-র গুণমান চিনা পণ্যের চেয়ে ভাল হলেও দামের প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে তারা। টিকে থাকার তাগিদে উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে পিটিএ বিক্রি করতে শুরু করে সংস্থাটি। ফলে বাড়তে থাকে লোকসানের বহর। এই অবস্থায় উৎপাদন কমিয়ে লোকসানে রাশ টানা সম্ভব ছিল। কিন্তু ক্রেতা ধরে রাখতে সেই পথে হাঁটেনি তারা।
লোকসান ঠেকানোর জন্য অন্য যে কাজটি করা দরকার ছিল, সেই উৎপাদন ব্যয় কমানোটাও নানা কারণে করে উঠতে পারেনি মিৎসুবিশি। প্রথমত, এ দেশে পিটিএ তৈরির কাঁচামালের দাম ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার সঙ্গে যোগ হয় অমিত মিত্র প্রচলিত পণ্য প্রবেশ কর। এই কর বাবদ প্রায় ৭০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে মিৎসুবিশির। অথচ গুজরাতে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সুবিধা পায় মুকেশ অম্বানীর রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ। সে রাজ্যে প্রবেশ কর থাকলেও পেট্রোপণ্য-সহ বিভিন্ন রাসায়নিক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ছাড় মেলে। সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের মতে, প্রবেশ কর দিতে হলে রিলায়্যান্সকে ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি বাড়তি খরচ করতে হতো। ধুঁকতে থাকা মিৎসুবিশিকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। পাশাপাশি বেড়েছে কিছু কেন্দ্রীয় করের বোঝাও।
কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়েও বাড়তি খরচের মুখোমুখি হচ্ছে মিৎসুবিশি। যার কারণ হলদিয়া বন্দরের সমস্যা। যথেষ্ট নাব্যতা না থাকায় কাঁচামালবাহী জাহাজকে জোয়ারের অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় স্যান্ডহেডে। আর এই সময়ের জন্য গুনতে হয় বাড়তি মাসুল। তার উপর এবিজি-বিদায়ের পরে হলদিয়া বন্দরে যন্ত্র দিয়ে মাল খালাসের ব্যবস্থা না-থাকায় সেই কাজেও বেশি সময় লাগে। খরচ বাড়ে তাতেও। মিৎসুবিশি কর্তাদের দাবি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আশ্বাস দিয়েছিলেন ২০০৭ সালের মধ্যে হলদিয়া বন্দরের সমস্যা মিটে যাবে। অমিত মিত্র তখন বণিক সংস্থা ফিকি-র সঙ্গে যুক্ত। একই আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনিও। কিন্তু ২০১৪ সালেও হলদিয়া সেই তিমিরেই।
মিৎসুবিশির নিজস্ব পরিকাঠামোগত কারণও অবশ্য উৎপাদন ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছে। ২০০০ সালে কারখানা পত্তনের সময় রাজ্যের বেহাল বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করে সংস্থাটি। দু’টি বিশাল জেনারেটর চালিয়ে তৈরি হয় কারখানা চালানোর সবটুকু বিদ্যুৎ। মূলত ফার্নেস অয়েল দিয়েই চালানো হয় জেনারেটর দু’টি। গত কয়েক বছর ধরে সেই জ্বালানির দাম ক্রমশই বাড়ছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ।
পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে গত বছর অগস্টে রাজ্য সরকারের কাছে প্রাথমিক ভাবে সাহায্যের আবেদন জানান মিৎসুবিশি কর্তৃপক্ষ। রাজ্যের তরফে তাঁদের বিআইএফআর-এ আবেদন করতে বলা হয়। সেই মতো পুনরুজ্জীবনের আবেদন পেশ করে মিৎসুবিশি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, গত বছরের শেষের দিকে বিআইএফআর-এ সংস্থার আবেদন নথিভুক্ত হয়েছে। বিআইএফআর-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া গত ১০ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, মিৎসুবিশির কেস নম্বর 3/2014। সেখানে জানানো হয়েছে, সংস্থাটি সত্যি সত্যি রুগ্ণ হয়ে পড়েছে কি না, তা যাচাই করার কাজ এখনও হয়নি। ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারও যে মিৎসুবিশির সঙ্কট কাটাতে সক্রিয় হয়েছে এমন নয়।
নিজেদের এই সঙ্গিন অবস্থার কথা অবশ্য প্রকাশ্যে জানাননি মিৎসুবিশি কর্তৃপক্ষ। কেন? সংস্থা সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের মনে হয়েছিল, এই অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু সেটা যে এত দীর্ঘমেয়াদি আকার নেবে, সেটা তাঁরা আন্দাজ করতে পারেননি। তা ছাড়া, রাজ্যের বন্ধ্যা শিল্প পরিস্থিতিতে এমন শো কেস শিল্পের এই বেহাল দশার কথা প্রকাশ্যে এলে বিতর্ক তৈরি হতে পারে, এই ভাবনাও সম্ভবত কাজ করেছিল তাঁদের মধ্যে।
কিন্তু মিৎসুবিশি কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে না-বললেও রাজ্য সরকারের তো বিআইএফআর-এ যাওয়ার বিষয়টি জানার কথা। বস্তুত, সরকারের পরামর্শেই সংস্থাটি বিআইএফআর-এ গিয়েছে বলে খবর। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক কিন্তু মঙ্গলবার দাবি করেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। ফোন ধরেননি শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। জবাব দেননি এসএমএসেরও।
তা হলে মিৎসুবিশির এখন ভবিষ্যৎ কী? সংস্থা কর্তৃপক্ষ বলছেন, কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা তাঁদের নেই। উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে পুনরুজ্জীবনের চেষ্টাই চালাচ্ছেন তাঁরা। সে জন্য রাজ্যের কাছ থেকে গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নেওয়ার পরিকাঠামো তৈরির প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। পাশাপশি ফার্নেস অয়েলের ব্যবহার কমিয়ে কোকিং কোলের ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। সংস্থার এক কর্তা বলেন, “এই দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পিটিএ উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমবে। সেই সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের থেকে শুল্ক বাবদ কিছু ছাড় পাওয়ার যে আবেদন করা হয়েছে বিআইএফআর-এ, তা বিবেচিত হলে ফের মিৎসুবিশি ঘুরে দাঁড়াবে। তবে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই।”
বস্তুত, মঙ্গলবারই কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনের পাওনাগণ্ডা সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে। তাতে কারখানা কর্তৃপক্ষ যা প্রস্তাব করেছিলেন শ্রমিক সংগঠনগুলি তা মেনে নিয়েছে। স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “গত ২০ মাস শ্রমিকদের বেতন বাড়েনি। তা সত্ত্বেও এক দিনের জন্যও ধর্মঘট, অবরোধ বা বিক্ষোভ হয়নি। এ বারে মালিকপক্ষ তিন বছরের বকেয়া কিস্তিতে মেটানোর যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা-ও মেনে নেওয়া হয়েছে। মিৎসুবিশি হলদিয়ার গর্ব। এই কারখানাকে রক্ষা করার জন্য শ্রমিকরাও লড়বেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy