Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Kumva at Tribeni and Kalyani

‘দেবতার জন্ম’ দেখেছিলেন লেখক শিবরাম, নতুন তীর্থের জন্ম দেখছে বাংলা, গঙ্গার এ পারে-ও পারে

বাংলা অনেক ‘দেবতার জন্ম’ দেখেছে। তীর্থের জন্মও কম হয়নি এই বাংলায়। আবার এক তীর্থের জন্ম হতে চলেছে। তার পিছনেও রয়েছে স্বপ্নভঙ্গ আর নতুন স্বপ্ন দেখার কাহিনি।

শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের কথাই মনে আসে নতুন কুম্ভের কথায়।

শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের কথাই মনে আসে নতুন কুম্ভের কথায়। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:১৫
Share: Save:

‘বাড়ি থেকে বেরুতে প্রায়ই হোঁচট খাই। প্রথম পদক্ষেপেই পাথরটা তার অস্তিত্বের কথা প্রবলভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। কদিন ধরেই ভাবছি কী করা যায়।’ এ ভাবেই শুরুটা করেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। ‘দেবতার জন্ম’ দেখেছিলেন। দেখিয়েছিলেনও। গল্পাকারে লিখে যাওয়া দেবতার জন্মবৃত্তান্তে হাঁটার গতিবেগ কমিয়ে দেওয়া পাথরটিকে একদিন মাটি থেকে উপড়ে ফেলেন। তার পরে সেই বড় গোছের নুড়ি ‘বাবা ত্রিলোকনাথ’ হয়ে ওঠেন। গল্পের শেষে লেখক নিজেও ‘জয় বাবা ত্রিলোকনাথ! রক্ষা করো বাবা! বম বম’ বলে মাটিতে মাথা লুটিয়ে প্রণাম করেন। উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখেন, কেউ দেখে ফেলেনি তো!

এ দেশে অনেক দেবতা জন্ম নিয়েছেন। এ বার এক নতুন তীর্থের জন্ম হতে চলেছে এই বাংলাতেই। কুম্ভমেলা বসেছে গঙ্গার এ পার-ও পার দুই শহরে। ইলাহাবাদের কুম্ভ, মহাকুম্ভের মতো।

নতুন তীর্থের শঙ্খ-নিনাদ।

নতুন তীর্থের শঙ্খ-নিনাদ। — নিজস্ব চিত্র।

হুগলির ত্রিবেণীতে রবি, সোম এবং মঙ্গলে কুম্ভস্নান হল। আসল কুম্ভ অবশ্য হয় মকর সংক্রান্তিতে। নতুনের তিথি মাঘী সংক্রান্তি। গত বছরেই নতুন কুম্ভ শুরু হয়েছে। দেখাদেখি গঙ্গার ঠিক ও পারে নদিয়ার কল্যাণীতেও বসেছে কুম্ভমেলা। এ বারেই প্রথম। সেখানেও তিন দিনের স্নান। সঙ্গে মেলা আর আখড়া। দু’পারেই সাধু-সন্ন্যাসীর ভিড়। একটু নজর করলে ‘নাগা’ সাধুও পাওয়া যাচ্ছে। গেরুয়া, ভক্তি, ডুব, ধূপ মিলে এক এলাহি কাণ্ড!

ইলাহাবাদের কুম্ভের সঙ্গে নতুন কুম্ভের কিছু কিছু মিলও রয়েছে। মাপে অনেক ছোট হলেও মিল তৈরির চেষ্টা অনেক। কুম্ভের ইতিহাস ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে। সাধারণত কুম্ভমেলা প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজিত হয়। প্রতি ছ’বছর অন্তর হরিদ্বার ও প্রয়াগে (ইলাহাবাদ) আয়োজিত হয় অর্ধকুম্ভ। আর প্রতি বারো বছর অন্তর প্রয়াগ, হরিদ্বার, উজ্জ্বয়িনী ও নাসিকে পূর্ণকুম্ভ। বারোটি পূর্ণকুম্ভ অর্থাৎ প্রতি ১৪৪ বছর অন্তর প্রয়াগে আয়োজিত হয় মহাকুম্ভ। সেটা হয়ে গিয়েছে ২০১২ সালে।

মেলা গঙ্গের এ পারে, ও পারে।

মেলা গঙ্গের এ পারে, ও পারে। — নিজস্ব চিত্র।

প্রয়াগের কুম্ভে ইলাহাবাদের দিকে গঙ্গার পারে হয় স্নানের ঘাট। গঙ্গার উপর তৈরি হয় অনেক অস্থায়ী সেতু। যা হেঁটে পার হয়ে পুণ্যার্থী এবং পর্যটকেরা যান ও পারের ঝুঁসিতে। সেখানে বসে বিভিন্ন মঠের আখড়া। এ পার-ও পার মিলিয়েই উৎসব। বাংলাতেও নতুন তীর্থ হতে চলা ত্রিবেণী ঘাট একা নয়। গত বছর একলা কাটালেও এ বার ঠিক ও পারে কল্যাণীতে তৈরি হয়েছে বাংলার ‘ঝুঁসি’। অস্থায়ী সেতু বানাতে হয়নি। স্থায়ী ঈশ্বর গুপ্ত সেতুই সম্বল।

প্রয়াগে যেমন ত্রিবেণী সঙ্গম, তেমনই বাংলাতেও। উত্তরপ্রদেশে গঙ্গা-যমুনার মিল দেখা যায়। সরস্বতী অন্তঃসলিলা। হুগলির ত্রিবেণীতে গঙ্গায় মিশেছে সরস্বতী (দেখে খাল মনে হয়)। একটু দূরে আছে কুন্তি নদী। ত্রিবেণী সঙ্গমই তো! সংস্কারহীন গঙ্গার হাল বলার মতো নয়। দূষণও ভরপুর। সরস্বতী বা কুন্তি পচে, মজে, হেজে গিয়েছে। তাতে কারও নজর নেই। সবাই ডুব দিচ্ছেন। মনে মনে কেউ চাইছেন সন্তান, কেউ বকেয়া ডিএ! আবার কারও মনে স্বামীর মঙ্গলকামনা। একই ছবি কল্যাণীর গৌরাঙ্গ প্রভু ঘাটে।

কল্যাণী কুম্ভে রাজনীতির ডুব।

কল্যাণী কুম্ভে রাজনীতির ডুব। — নিজস্ব চিত্র।

দেবতার মতো তীর্থের জন্মও দেখেছে এই বাংলা। তবে এগিয়ে দেবতাই। ‘ভয়’ থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্রের। প্রকৃতির কাছে হেরে যাওয়ার ভয়েই ভক্তিতে আশ্রয়। বিভিন্ন শক্তির প্রতীক হিসেবে দেবতার কল্পনা করে মানুষ পুজো শুরু করেছিল। বসন্তের মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল শীতলা দেবীর। ওলাওঠা থেকে রক্ষা পেতে জন্ম নেয় ওলাবিবি থান।

প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’ উপন্যাসে রয়েছে তখনকার ‘বোম্বে’ থেকে হাওড়া স্টেশনে এসে ঘোড়ার গাড়িতে ওঠেন লেখক। যান হ্যারিসন রোডে (এখনকার মহাত্মা গান্ধী রোড)। সেখানে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানকে দিব্যদর্শন দিয়েছিলেন স্বয়ং ‘প্লেগ দেবী’। তবে ‘আমাকে চিনিতে পারিলি না?’ বলেই অন্তর্হিত হয়েছিলেন তিনি।

বিশ্বাসীরা অবশ্য সন্দেহকে পাত্তা দিতে চান না। ত্রিবেণীর নতুন কুম্ভের প্রচারপত্রের মাথায় ছাপার অক্ষরে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের ‘অনুপ্রেরণা’ রয়েছে। যদিও ভক্তিমানেরা বলছেন, এগুলো বিনিয়োগ। কিছু দিন পর ‘ডিভিডেন্ড’ মিলবে। দক্ষিণেশ্বরের উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলেন, কেউ চিনতেন না জায়গাটা। রানি রাসমণি ভবতারিণী মায়ের মন্দির গড়লেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পূজারী হয়ে এসে অবতার হলেন। তাঁর টানে এলেন বিবেকানন্দ। কাছেই হল বেলুড় মঠ। এখন দক্ষিণেশ্বরে মেট্রো রেল এসেছে। স্কাই ওয়াক হয়েছে। দোকান, বাজার, টোটো, অটো, জবাফুল, গুজিয়া, কচুরির বাজার তৈরি হয়ে গিয়েছে দক্ষিণেশ্বরে। কেন্দ্র থেকে রাজ্য— সকলের বিনিয়োগ আসছে। যেমন ‘তীর্থের জন্ম’ হয়েছে চাকলাধাম, ঠাকুরনগরে। যেমন হতে পারে ত্রিবেণী আর কল্যাণীতেও। ফুল, মালা, ধূপ, খেলনা, কানের দুলের বাজার বসেছে কুম্ভের তিন দিনে। টাকার লেনদেনের পরিমাণ খুব কম নয়।

একদা ত্রিবেণী, বাঁশবেড়িয়া এলাকায় শিল্প তৈরির কথা ছিল। ডানলপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আরও কাগজ কারখানা, চটশিল্প ধুঁকছে। ত্রিবেণী টিস্যু, কেসোরাম রেয়ন-সহ আরও অনেক কারখানাই ধিকিধিকি করে কোনও মতে টিকে আছে। থাকার মধ্যে রয়েছে শুধু ব্যান্ডেল থার্মাল পাওয়ার স্টেশন। বাঁশবেড়িয়ার গর্ব বলতে হংসেশ্বরী মন্দির আর অতীতের বন্দর শহর আদি সপ্তগ্রামের জায়গা শুধুই ‘ইতিহাস’ বইয়ে। যেমন স্বপ্নভঙ্গের শহর কল্যাণী। ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ হয়ে ওঠার কথা ছিল এক সময়। বাংলার অন্যতম সফল মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় সেই স্বপ্ন দেখেই এই শহরকে সাজাতে চেয়েছিলেন। কল্যাণী এখন বেঁচে আছে কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল আর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। ঈশ্বর গুপ্ত সেতুর হাত ধরে মিলে থাকা দু’পারের দুই স্বপ্নভঙ্গের শহর এখন তীর্থক্ষেত্র হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

শিবরাম থাকলে নিশ্চয়ই করজোড়ে প্রণাম করতেন বাংলার নতুন তীর্থকে। তার পরে চারদিক দেখতেন, কেউ দেখে ফেলেনি তো!

অন্য বিষয়গুলি:

Tribeni Kalyani Kumbh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy