প্রকল্পের মোট খরচ সাড়ে চার হাজার কোটি। রাজ্য সরকার জমির দাম বাবদই চেয়ে বসল চার হাজার কোটি টাকার বেশি! আর সেই দাবিদাওয়ার জেরে আরও গভীর জলে চলে গেল জমি জটে এমনিতেই জেরবার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের ভবিষ্যৎ। কেননা, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন দফতরের সাফ কথা, জমির জন্য এত টাকা দিতে হলে প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া গতি নেই।
২০০৪ সালে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার মিলে যখন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর পরিকল্পনা করেছিল, তখন ১৪.৬৭ কিলোমিটার রেলপথ তৈরির খরচ ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। তখন ঠিক ছিল রাজ্য, কেন্দ্র এবং জাপানি সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জাইকা) প্রকল্পের খরচ জোগাবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি রাজ্য সরকারের অংশীদারি রেলের হাতে নিতে চান। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রকল্পে রাজ্যের অংশ রেলকে হস্তান্তর করা হয়। তখনও রেল মন্ত্রক তৃণমূলেরই হাতে।
কিন্তু মমতার দল তৎকালীন ইউপিএ সরকার ছেড়ে চলে আসার পরেই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো নিয়ে একের পর এক সমস্যা মাথাচাড়া দেয়। কখনও দত্তাবাদে বস্তি উচ্ছেদ, কখনও আবার সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের কাছে জমি অধিগ্রহণ। জমি অধিগ্রহণে অনিচ্ছুক রাজ্য প্রস্তাবিত রুটটাই পাল্টে দেওয়ার দাবি করে। সে সমস্যা এখনও মেটেনি। তার মধ্যেই মাথাচাড়া দিল নতুন সমস্যা। জমির দাম নিয়ে রাজ্যের দাবিকে কেন্দ্র করে।
কলকাতা মেট্রো রেল নিগম সূত্রে বলা হচ্ছে, সেন্ট্রাল পার্কে সাড়ে ৩৮ একর (২৩২৯.২৫ কাঠা) জমিতে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর মূল ডিপোটি তৈরি হয়েছে। ২০১০ সালে ৭ জানুয়ারি এই জমি মেট্রোর হাতে তুলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতরের অতিরিক্ত সচিব কলকাতা মেট্রো রেল নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী কাঠাপিছু ১ কোটি ৪৪ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা হিসেবে মোট ৩৩৬৮ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা চিঠি পাঠানোর ৬০ দিনের মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে।
শুধু সেন্ট্রাল পার্ক নয়, সল্টলেকে দত্তাবাদ ও সংলগ্ন এলাকায় স্টেশন নির্মাণ ও লাইন পাতার জন্য যে জমি মেট্রো ব্যবহার করেছে, তার জন্যও টাকা চেয়েছে রাজ্য। এখানে মেট্রোর ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৬৭৮ কাঠা। ১৩ ফেব্রুয়ারি পাঠানো চিঠিতে জমির দাম এবং ওয়েলিভ চার্জ (অন্যের জমি নিজের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রদত্ত ফি) হিসেবে মোট ৮৮৯.৬৯ কোটি টাকা দাবি করেছেন রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতরের অতিরিক্ত সচিব। এ ক্ষেত্রেও চিঠি দেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে টাকা মেটাতে বলা হয়েছে।
সব মিলিয়ে রাজ্য সরকারের দাবির পরিমাণ ৪২৫৯ কোটি টাকা। যে টাকা কোনও ভাবেই দেওয়া সম্ভব নয় বলে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য। মন্ত্রকের যুক্তি, প্রাথমিক ভাবে প্রকল্পে যে খরচ ধরা হয়েছিল, রাজ্য সরকার এখন প্রায় তার সমপরিমাণ টাকা চেয়ে বসেছে। এই দাবি মানা সম্ভব নয়। এ নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশও নেই। তাতে প্রকল্প মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেলেও কেন্দ্রের কিছু করার থাকবে না।
রাজ্যের সাংসদ তথা নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় সোমবার বলেন, “যা মতিগতি দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, রাজ্য ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প আদৌ চায় না। যদি ৪ হাজার কোটি টাকা জমির দাম মেটাতে হয়, তা হলে এই প্রকল্প হবে না বলে রেল মন্ত্রক আমাকে জানিয়েছে।” বাবুলের আক্ষেপ, মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো নিয়ে তিনি লেগে রয়েছেন। কিন্তু প্রকল্পে সাহায্য করার বদলে রাজ্য সরকার যে নতুন নতুন ফ্যাকড়া তুলবে, তা ভাবতে পারেননি তিনি। এবং রাজ্যের এই নতুন চিঠি পাওয়ার পরে প্রকল্পটি নিয়ে আর কোনও আশা দেখছেন না নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী।
রাজ্য জমির জন্য এই বিপুল পরিমাণ টাকা চাইছে কেন?
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “রাজ্য তার দাবি জানিয়েছে। মেট্রো কী চায়, তা কেন্দ্র জানাক। দাম নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু জমির দাম ওদের দিতে হবে।” তবে রাজ্যের এক কর্তা জানাচ্ছেন, মেট্রোর রুট বদল নিয়ে রাজ্যের দাবি উড়িয়ে দেওয়ার সময় কেন্দ্রের তরফ বারবার এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পে রাজ্যের কোনও ভূমিকাই নেই। তারা জোর করে নিজেদের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘটনা হল, এই প্রকল্পে রাজ্য এই বিপুল পরিমাণ জমি দিয়েছে। যার বর্তমান বাজারদর চার হাজার কোটি টাকার বেশি। জমির দাম চেয়ে আদতে এই সত্যটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে। ওই কর্তা আরও দাবি করেন, এর আগেও মেট্রোকে ২২৭ কোটি টাকা মকুব করেছে রাজ্য। এ ছাড়া, মূলধন হিসেবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগও করেছে তারা। ফলে এই প্রকল্পে রাজ্য মোটেই ‘বহিরাগত’ নয়।
কিন্তু ‘চোখে আঙুল দিয়ে’ দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বলে মনে করছেন রেলের কর্তারা। রাজ্যের নয়া দাবি প্রসঙ্গে বাবুল সুপ্রিয় বলেন, “হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে এই প্রকল্প নিয়ে নতুন করে আশার আলো দেখা গিয়েছিল। সেখানে মামলার শুনানির সময় রাজ্য এক বারও এ সব কথা বলেনি। হঠাৎ চিঠি লিখে চার হাজার কোটি টাকা দাবি করার কারণ কী, তা বোধগম্য হচ্ছে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy