অল্প সময়ে এগোনো গিয়েছে অনেকটাই। তবু অনেক পথ এখনও বাকি! এবং সে জন্য সংগঠন সামলে ঝাঁপাতে হবে রাজনীতির ময়দানে। এ বারের জোড়া উপনির্বাচন থেকে এক নজরে বিজেপির জন্য বার্তা এটাই।
এমনিতে বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জ তৃণমূলের দুর্গ। সারদা কেলেঙ্কারি থেকে দুর্নীতি, অপশাসন নিয়ে রাজ্য জুড়ে প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও এই দুই কেন্দ্রে তাদের জয় একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু এই উপনির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক বিজেপির অপ্রতিহত উত্থান। উপনির্বাচনে কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে দ্বিতীয় এবং বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে তৃতীয় হয়েছে বিজেপি। কিন্তু ৮ মাস আগের লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে দুই কেন্দ্রেই তাদের ভোট যথেষ্ট বেড়েছে। লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁয় তারা পেয়েছিল ১৯% ভোট। উপনির্বাচনে ওই কেন্দ্রে ভোট বেড়েছে ৬%। পাশাপাশি, গত বছর লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা এলাকায় বিজেপি পেয়েছিল সাড়ে ১৪% ভোট। এ বার ওই কেন্দ্রে তাদের ভোটের হার বেড়েছে আরও ১৪%! সাধারণ ভাবে বামেদের বাক্স থেকে বেরিয়ে আসা ভোট ঢুকেছে বিজেপির ঝুলিতে। আর এক বিরোধী দল কংগ্রেস দুই কেন্দ্রেই মাত্র ২% করে ভোট পেয়ে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক! স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যে বিরোধী পরিসর দখলের লড়াইয়ে আরও এগিয়ে যেতে পেরে গেরুয়া শিবিরে খুশির হাওয়া।
কিন্তু এই স্বস্তির আড়ালেও বিজেপির জন্য উদ্বেগের বার্তা থাকছে। কারণ, এই ভোট একই সঙ্গে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, সংগঠন গড়ে তুলতে না-পারলে বামেদের ভেঙে আসা ভোট ঘরে তুলেই থেমে যেতে হবে তাদের। তৃণমূলকে টপকে যাওয়া এখনও দূরের ভাবনা! রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের মতে, তৃণমূলের এই জয় আসলে উদ্দীপনার উপরে সংগঠনেরই জয়! সাংগঠনিক প্রশ্নে যেখানে শাসক দলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পেরেছে বিজেপি, সেখানে তাদের ফল তুলনামূলক ভাবে বেশি ভাল হয়েছে। যেমন কল্যাণী বিধানসভা কেন্দ্র। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট যে ২০১৪-র তুলনায় বেশ খানিকটা কমে এসেছে, তার কারণ সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিজেপির সাফল্য। ওই নেতাদের মতে, বাংলায় ভোটে জিততে সংগঠনের ভূমিকাই ৭০%। বাম আমলেও সেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তখন মমতার পক্ষে বিপুল হাওয়া থাকলেও ভোটের বাক্সে কখনওই কাঙ্খিত সাফল্য পাননি তিনি। সেই সাফল্য আসে মুকুল রায় রাজ্য জুড়ে সংগঠন গড়ে তোলার পরেই। ২০১৬-তে লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে এই সত্য মাথায় রাখতে হবে বিজেপি-কে।
অন্য বিরোধীদের দুর্বলতায় রাজ্যের রাজনৈতিক আবহাওয়া এখন অনেকটাই বিজেপির অনুকূলে। তৃণমূল থেকে মন্ত্রী ভাঙিয়ে আনা, কুমার শানু, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকা থেকে শুরু করে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রচার এত কিছুর পরেও তৃণমূলের থেকে অনেক পিছনে কেন শেষ করতে হল বিজেপি-কে? এই প্রশ্ন উঠছে বিজেপির অন্দরে। দলের একাংশেরও বক্তব্য, শুধু নাম, তারকা বা বাণীর জোরেই ভোট জেতা যায় না। ভোটে জিততে সংগঠন লাগে এবং তা গড়তে শ্রম, সময় ও মনোযোগ দিতে হয়। উপনির্বাচনের ফল সেই সত্যকেই আর এক বার প্রমাণ করছে। বিজেপি নেতাদের অনেকেই বলছেন, দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ সংগঠন করার লোক নন। তারই মাসুল দিতে হল জোড়া উপনির্বাচনে।
ঠিক যেমনটা দিয়েছিল সিপিআই। ছয়ের দশকে তাদের দলে অনেক খ্যাতিমান নেতা থাকলেও সংগঠন ছিল না। কিন্তু সিপিএম সংগঠন গড়ে তুলেছিল। অনিল বিশ্বাস প্রচারের আলোর বাইরে থেকে সংগঠন গড়ায় মন দিয়েছিলেন। যে কারণে এই দুর্দিনেও সিপিএম কিছুটা ভোট ধরে রাখতে পারছে। আবার অনিলের প্রয়াণে সংগঠনে তৈরি হওয়া শূন্যতা তারা এখনও যে পূরণ করতে পারেনি, তা-ও ধারাবাহিক ভোটে স্পষ্ট। কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপি এখনও অনিল বা মুকুলের মতো কোনও সংগঠক খুঁজে পায়নি। এমন কেউ, যিনি মন্ত্রী হতে দৌড়বেন না, সাংবাদিক সম্মেলন করার জন্য ব্যস্ত হবেন না। এমন কেউ, যিনি হইচই এড়িয়ে সংগঠনকেই নিপুণ হাতে বুনবেন।
সংগঠন নেই বলে বিজেপির প্রচারেও খামতি থেকে গিয়েছে। শুধু ‘ভাগ মমতা ভাগ’ স্লোগান দিয়ে, কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজ্যে এনে একটা দু’টো সভা করিয়ে যে ভোটে জেতা যায় না, এই সার সত্যটা রাজ্যের বিজেপি নেতারা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। সে জন্য গ্রামগঞ্জের নিজস্ব সমস্যা, স্থানীয় মানুষের দাবিদাওয়াকে হাতিয়ার করে রাজনীতির ময়দানে নামার দরকার ছিল। সেই আসল কাজটাই হয়নি।
বিজেপির উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নেতা-কর্মীদের অনেকেই যেমন বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের ভিড় সামলাতে গিয়ে প্রচারে পরিকল্পনার অভাব থেকে গিয়েছে। নিচুতলায় সংগঠন চাঙ্গা করা হয়নি। কৃষ্ণগঞ্জের ব্লক স্তরের বিজেপি কর্মীদেরও আক্ষেপ, রাজ্য নেতৃত্ব এবং তারকাদের পিছনে ছুটতেই তাঁদের সময় চলে গিয়েছে!
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহও এখন এ রাজ্যে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন। এ দিন ফল প্রকাশের পরে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বিজেপির শীর্ষ সূত্রের খবর, সংসদের অধিবেশন চলার সময় রাহুলবাবুকে দিল্লিতে ডেকে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানো নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করতে চান খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিজেপি-র এক শীর্ষ নেতার কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে দৌড়টা ম্যারাথনের। সিপিএমকে হারাতেও ৩৪ বছর সময় লেগে গিয়েছে। এখনই মমতাকে পরাস্ত করা যাবে, এ কথা বলার সময় আসেনি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র আর নেতা দরকার নেই! দরকার কর্মীর।”
রাহুলবাবু অবশ্য মনে করছেন, দল যে কৃষ্ণগঞ্জে নগণ্য অবস্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসতে পেরেছে, এটাই দলের বিরাট সাফল্য। আর বনগাঁর কল্যাণী এবং গয়েশপুরে ১০০টি বুথে তৃণমূল ভোট লুঠ করতে না পারলে সেখানেও বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে থাকতে পারত। এই প্রেক্ষিতে রাহুলবাবু বলেন, “কয়েক মাস আগেও লোকে বিজেপি-র অস্তিত্ব নিয়ে ঠাট্টা করত! সেই দল এখন কৃষ্ণগঞ্জে দ্বিতীয় হয়েছে। আর বনগাঁয় তৃতীয় হলেও কার্যত দ্বিতীয়ই ধরতে হবে। সব দলের ভোট যখন কমছে, তখন বিজেপি-র ভোট বাড়ছে। এ রাজ্যে বিজেপি-র অগ্রগতি অব্যাহত।”
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহের বক্তব্য, উপনির্বাচন থেকে বিজেপির কাছে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক, তৃণমূলের অবক্ষয় এবং বিজেপির উদয় শুরু হয়ে গিয়েছে। দুই, ২০১১ সাল এবং ২০১৪ সালের ভোটের নিরিখে বিজেপি নিজের জমি আরও শক্ত করেছে। আর তিন, সিপিএম-কে ভোট দেওয়া মানে তৃণমূলকে ভোট দেওয়া!
সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এ কথা বলেছেন এটা জেনেই যে, তৃণমূলের কাছাকাছি পৌঁছনোর পথে তাঁদের সামনে অন্যতম অন্তরায় হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে বামেরা। তাদের ভোট ভেঙে বিজেপি-র দিকে ঢুকলেও ভোটব্যাঙ্ক এখনও কংগ্রেসের মতো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এবং সেই কারণেই সিপিএম পাল্টা বলতে পারছে, আসলে বিজেপি-কে ভোট দেওয়া মানেই বিরোধী ভোট ভাগাভাগি করে তৃণমূলকে সুযোগ করে দেওয়া!
উপনির্বাচনের ফলের পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, “প্রাথমিক ভাবে বলা যায়, যাঁরা নিরাপত্তার কথা ভেবে, নিশ্চয়তার কথা ভেবে বিজেপি-কে ভোট দিচ্ছেন, তাঁরা আসলে ভোটটা দিচ্ছেন তৃণমূলকে! কারণ, তাতে তৃণমূল উপকৃত হচ্ছে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy