‘ইউনেস্কো হেরিটেজ’ শান্তিনিকেতন। —ফাইল চিত্র।
জার্মানির ড্রেসডেনের এলবে উপত্যকার নামটা হয়তো কারও মনে পড়ছে শান্তিনিকেতনের বিশ্ব স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে। এলবে নদীর কিনারে কয়েক শতকের সাংস্কৃতিক তাৎপর্যমণ্ডিত নিসর্গ ও স্থাপত্য। ২০০৪ সালে যা উঠে আসে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তালিকায়। কিন্তু মাত্রাছাড়া নির্মাণকাজের দরুন ২০০৬-এই বিপন্ন বলে ঘোষিত হয়। শেষমেশ চার লেনের একটি সেতু নির্মাণের জেরে ২০০৯-এ বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের মর্যাদাই কেড়ে নেয় ইউনেস্কো।
‘বিশ্ব ঐতিহ্য’-তালিকা থেকে ‘ডিলিস্টেড’ বা ছাঁটাই হওয়ার নমুনাগুলি শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের জন্য শিক্ষণীয় বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন। ইউনেস্কো-স্বীকৃতির জন্য শান্তিনিকেতনে তোড়জোড় শুরু হওয়ার পিছনেও রবীন্দ্রতীর্থের অকৃত্রিম রূপ নষ্ট করে যথেচ্ছ নির্মাণ-কাণ্ডের ভূমিকা ছিল। সেটা ২০০৯-এর কথা। দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন মনমোহন সিংহ। আবার ২০২০ সালেও বর্তমান বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের পাঁচিল তোলার জেদে ব্যথিত হন বহু রবীন্দ্র অনুরাগী। শান্তিনিকেতনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই সব ঘটনা থেকে সতর্ক হওয়ার আছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
স্বীকৃতির কারণ হিসেবে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের উদার বিশ্ববোধের আলোয় গড়ে ওঠা স্থাপত্যের কথা বলেছে ইউনেস্কো। উপনিবেশের অনুকরণে না হেঁটে প্রাচ্যের নান্দনিকতারও যা স্মারক। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক ও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (এএসআই) উদ্যোগে বিশ্ব-স্বীকৃতি এলেও এ বার তা অটুট রাখতে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকেই উদ্যোগী হতে হবে। বিশ্বভারতীর তরফে অবশ্য দায়িত্বের গুরুত্ব বুঝেই দরকারি পদক্ষেপ করা হবে বলে জানানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, বিশ্বভারতীর হেরিটেজ কমিটি ঢেলে সাজাতে হবে। বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের শর্ত মেনে, ওই তল্লাটে আরও ফলক বসানো, স্থাপত্যের মেরামতি, ‘গাইড’ মোতায়েনও সুষ্ঠু ভাবে করতে হবে। চিহ্নিত ৩৬ হেক্টর জমির লাগোয়া অংশেরও (বাফার এরিয়া) সুরক্ষা আবশ্যক। ইউনেস্কোর উপদেষ্টা সংস্থা আইকোমসের সুপারিশে চার মাস আগেই নিশ্চিত ছিল শান্তিনিকেতনের স্বীকৃতি। প্রশ্ন উঠছে, বিষয়টি নিয়ে কী ভেবেছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ? সেই সঙ্গে এই স্বীকৃতির পরে পর্যটক সামলাতে কেন্দ্র বা রাজ্যের সঙ্গে বিশ্বভারতীর সমন্বয় পরিকল্পনা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনও স্পষ্ট রূপরেখা মেলেনি। জনসংযোগ আধিকারিক মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাড়তি দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে পরিস্থিতি বুঝেই কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবেন।”
২০১০-এ শান্তিনিকেতনের ইউনেস্কো-স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা সফল হয়নি। ২০২১-এর গোড়ায় ফের বিশ্ব-স্বীকৃতির জন্য কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। কারও কারও মত, সেই তৎপরতার সঙ্গে সে-বছর নির্দিষ্ট পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের যোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে কারণ যা-ই থাক, আখেরে এই মর্যাদায় দেশের মুখ উজ্জ্বল হওয়া নিয়ে দ্বিমত নেই। অবশ্য ২০১০ সালে ইউনেস্কো স্বীকৃতির আর্জির সময়ে মূল পরিকল্পনাটি গৃহীত না হওয়ার আক্ষেপ রয়েছে সেই উদ্যোগের স্থপতিদের মধ্যে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব জহর সরকারের মতে, “এটা অনেকটা ভ্যাটিকান সিটি বাদ দিয়ে শুধু ভ্যাটিকানের গির্জার স্বীকৃতির মতো হল।” তবে গোটা শান্তিনিকেতন জুড়ে নানা ধরনের সড়ক, জনপদ মিলিয়ে স্থাপত্যগত সমন্বয়ের চেহারাটা ছিল না, এটাও মানতে হচ্ছে।
আবার এই স্বীকৃতি দীর্ঘ দু’দশক আগে শান্তিনিকেতন বাঁচানোর আন্দোলনেরও ফসল বলে মনে করাচ্ছেন সেই উদ্যোগটির গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব শান্তিনিকেতনের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ। মহাশ্বেতা দেবী, যোগেন চৌধুরী প্রমুখ অনেকেই ‘আমরা সবাই’ বলে একটি মঞ্চের সঙ্গে ছিলেন। শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতনের আদি, অকৃত্রিম চেহারাটি বিকৃত করে নির্মাণের ঘনঘটা নিয়ে তাঁদের ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু হাই কোর্টে শান্তিনিকেতন বাঁচানোর মামলায় তাঁরা হেরে যান। তবে ২০০৫-এর মার্চে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, শান্তিনিকেতনের ঘরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের ছাপই ধরে রাখতে হবে।
তবু এতেও শান্তিনিকেতন রক্ষার উদ্যোগ ধাক্কা খাচ্ছিল। ফলে মহাশ্বেতা দেবী, পার্থ ঘোষ, সমর বাগচী প্রমুখ তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর দ্বারস্থ হন। গোপালকৃষ্ণ শান্তিনিকেতন রক্ষায় একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। রোমিলা থাপার, আন্দ্রে বেতেই প্রমুখ তাতে ছিলেন। তাঁরাও শান্তিনিকেতনের চরিত্র অটুট রাখায় কড়া হতে বলেন। পার্থের কথায়, “শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতন রক্ষার একমাত্র পথ হিসেবেই আমরা ইউনেস্কোর তকমা আদায়ের কথা ভাবি।”
২০০৯ নাগাদ শান্তিনিকেতনকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র হিসেবে মেলে ধরার পরিকল্পনায় তৎকালীন উপাচার্য রজতকান্ত রায়ও সায় দেন। সংস্কৃতি সচিব জহর সরকার, এএসআই-এর মহা অধিকর্তা গৌতম সেনগুপ্তের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতন ঘিরে প্রস্তাব তৈরির কাজও এগোতে থাকে। ২০১০-এ সংরক্ষণ স্থাপত্যবিদ আভানারায়ণ লাম্বা, মণীশ চক্রবর্তীদের প্রস্তাবটি অবশ্য তখনই ইউনেস্কোয় গৃহীত হয়নি। শান্তিনিকেতনের ‘অসামান্য সর্বজনীন মূল্য’ নিয়ে ইউনেস্কোর উপদেষ্টারা প্রশ্ন তোলেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের পরামর্শ নিয়ে ফের প্রস্তাবটি লেখা হয়। কেন্দ্র ফের ২০২১-এ প্রস্তাবটি পেশ করে। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন প্রস্তাবটি ইংরেজি ছাড়া আরবি, ফরাসি, স্প্যানিশ, চিনা ইত্যাদি ভাষায় তর্জমায় সহায়তা করেন।
স্বীকৃতির পরে শান্তিনিকেতনের মূল আশ্রমের এলাকা ও লাগোয়া শিক্ষাপ্রাঙ্গণটুকুতে হয়তো উটকো নির্মাণের হাত থেকে রেহাই মিলবে। এটুকুই আশা রবীন্দ্র অনুরাগীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy