শ্যুটিংয়ের ফাঁকে। তারাতলায় কলকাতা বন্দরের জমি দখল করে নির্মিত স্টুডিওয়। ছবি: সুমন বল্লভ।
দুপুরের খাওয়া সেরে ‘গণেশ’ বোধহয় তখন একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরতে বেরিয়েছে! হলুদ ধুতি, গা ভর্তি সোনালি গয়না, মাথায় নকল বাবরি চুল, তাতে সোনালি মুকুট। শুঁড়টা অবশ্য তখনও লাগানো হয়নি! তবে ‘গণেশ’কে চিনতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল না। ইশারা করে ডাকতে গুটিগুটি পায়ে কিছুটা এগোতেই এক রকম চিলের মতো ছোঁ মেরে শিশুটিকে মেকআপ রুমে ঢুকিয়ে দিল দু’-তিন জন মুশকো চেহারার বাউন্সার! ‘‘এইটুকু একটা বাচ্চার সঙ্গে কথা বললেও আপনাদের এত ভয়?’’ বাউন্সারদের উদ্দেশে চিৎকার করে প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই ঠান্ডা গলায় উত্তর এল, ‘‘স্টুডিওর ভিতরে কারও সঙ্গে কোনও কথা বলা যাবে না। উপর থেকে বারণ আছে।’’
তারাতলায় কলকাতা বন্দরের জমিতে বেআইনি ভাবে নির্মিত স্টুডিও এলাকা রবিবার সকালে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস পুনর্দখল করার পর থেকে সেখানে তল্লাশি না করে মাছি পর্যন্ত গলতে দেওয়া হচ্ছে না। তবু তারই ফাঁক গলে মঙ্গলবার স্টুডিও চত্বরে ঢুকে দেখা গেল অদ্ভুত এক থমথমে পরিবেশ। কয়েকটি বাংলা সিরিয়ালের শ্যুটিং করতে যে সব শিল্পীরা স্টুডিওতে হাজির হয়েছেন, যাঁরা টেকনিশিয়ান— প্রায় সবার মধ্যেই একটা চাপা আতঙ্ক। কী যেন লুকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা! কোথায় সেই হাসি-ঠাট্টা-কলরবের চেনা ছন্দ! সব কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। সবাই কেমন যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছেন। যেখানে মুখ খুললেই কড়া চাহনি আর বাউন্সার নামধারী নিরাপত্তা কর্মীদের মুখের সামনে পড়তে হবে!
স্টুডিওর কিছু কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে মঙ্গলবার সকালে দমদমের একটি নতুন সংস্থা থেকে বাউন্সারদের ভাড়া করে আনা হয়েছে। এরা অনেক পেশাদার, দক্ষ এবং কাজ হাসিল করতে ওস্তাদ হিসেবেই পরিচিত বলে জানালেন ওই কর্মীরা। স্টুডিওর প্রায় সর্বত্র ওদের আনাগোনায় টেকনিশিয়ান, কর্মী, অভিনেতা-কলাকুশলী সকলেই কেমন যেন ত্রস্ত, সিঁটিয়ে রয়েছেন। দেখা গেল, স্টুডিওর গেট দিয়ে প্রতিটি গাড়ি ঢোকার আগে তল্লাশি হচ্ছে, নাম-পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই ভিতরে ঢোকার অনুমতি মিলছে।
ভিতরে পর পর পাঁচটি স্টুডিও। তিনটি স্টুডিওর দরজা বন্ধ, দু’টি খোলা। এ দিক-সে দিক ছড়িয়ে দশ-বারো জনকে দেখা যাচ্ছিল। জটলা করে নিচু গলায় আড্ডা মারছেন। কেউ হাতে থালা নিয়ে ভাত খাচ্ছেন। এক পাশে গাছের নীচে পেল্লায় সাইজের দু’টো পিতলের হাঁড়ি মাজা হচ্ছে। সম্ভবত আসন্ন বিশ্বকর্মা পুজোর প্রস্তুতি। তার পাশেই মাংস-ভাত রান্না হচ্ছে প্রোডাকশনের লোকজনের জন্য। অপরিচিত মনে হলেই আগন্তুককে সন্দেহের চোখে মেপে নিচ্ছেন, এড়িয়ে যাচ্ছেন। সবই হচ্ছে, তবে নিঃশব্দে!
কথা বলার তাগিদে আচমকা ঢুকে পড়া গেল একটি মেকআপ রুমে। জানা গেল, ‘মা দুর্গা’ সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মেকআপ রুম এ’টি। ভিতরে দু’জন অভিনেত্রী মেকআপ নিয়ে বসে আছেন। একজনের চুল বাঁধা হচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সবে কথা শুরু হয়েছে। এ দিক-ও দিক তাকিয়ে কিছুটা সতর্ক ভঙ্গিতে সবে তাঁরা বলতে শুরু করেছেন, ‘‘সবাই ভীষণ ঘাবড়ে আছে এখন। কী যে সব হয়ে গেল! আমরা তো শুনেছিলাম পুজোর পরে এখান থেকে স্টুডিও সরে যাবে। কিছু সিরিয়ালও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তার আগেই ছুটির দিনে কী সব কাণ্ড....!’’ এক অভিনেত্রীর কথা শেষ না-হতেই ধূসর টি-শার্ট আর সবুজ স্ট্রাইপ টি-শার্ট পরা দু’জন তাগড়াই বাউন্সার ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘‘কোনও ছবি নেবেন না, কোনও কথা বলবেন না এখানে। বেরিয়ে যান!’’
মহিলা নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া কোনও মহিলাকে এই ভাবে বের করে দেওয়া যায় না বলতেই তাঁরা সাময়িক কুঁকড়ে গেলেন। মোবাইলটাও ফেরত পাওয়া গেল। এ বার শুরু হল তাঁদের কাকুতি-মিনতি, ‘‘ঝামেলা বাড়াবেন না, দয়া করে গেটের বাইরে চলে যান! নয়তো আমাদের চাকরি চলে যাবে। বুঝতেই পারছেন।’’ অগত্যা মেকআপ রুম থেকে বেরোতেই হল। বাউন্সারদের কাছে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। কিন্তু ওই গোত্রের কারও হদিশ দিতে পারলেন না তাঁরা।
ততক্ষণে অবশ্য স্টুডিওয় সাংবাদিক ঢুকে পড়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। অবাঞ্ছিতকে নজরবন্দি করে রাখতে কার্যত ঘিরে ফেলা হল। তার মধ্যেই কয়েক জন মুখ ঢাকতে ব্যস্ত। মুখ ঢাকছেন কেন? আপনারা কি রবিবারের ঘটনায় জড়িত ছিলেন? প্রশ্ন করতে মুখ ঢেকেই উত্তর এল, ‘‘না, না, ওই দিন তো কাকদ্বীপে এক কাজু ব্যবসায়ীর মেয়ের বিয়েতে নিরাপত্তার ডিউটিতে ছিলাম আমরা।’’ তা হলে মুখ ঢাকছেন কেন? এ বার এক জন বললেন, ‘‘আপনি মোবাইলের ক্যামেরা বন্ধ করুন। এখানে ছবি তোলা বারণ আছে।’’ কারা রবিবার এখানে ডিউটিতে ছিলেন? এ বার কোনও উত্তর নেই। সকলের ঠোঁট যেন সেলাই করা!
স্টুডিওতেই দেখা হয় অভিনেত্রী দোলন রায়ের সঙ্গে। বললেন, ‘‘প্রায় ৭০০ কলাকুশলী এখানে কাজ করেন। সবাই জানত যে এখান থেকে চলে যেতে হবে। হঠাৎ রবিবার বন্দরের লোকেরা এসে পড়ায় হয়তো মাথা গরম করে ফেলেছিল। পেটে টান পড়লে আর মাথার ঠিক থাকে না।’’ প্রবীণ অভিনেতা দীপঙ্কর দে-র কথায়, ‘‘শ্যুটিংয়ের ফাঁকে এ সব নিয়ে আলোচনা তো চলছেই। বেশি দিন বোধহয় আর কেউ নেই এই চত্বরে।’’
এ দিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, রবিবার সাংবাদিক নিগ্রহ থেকে শুরু করে যে তিনটি ঘটনা নিয়ে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, তার তদন্ত শুরু হয়েছে। যদিও পুলিশেরই একটি অংশের অভিযোগ, রবিবারের ঘটনার পর আর স্টুডিও চত্বরেপা রাখেনি তাঁরা! সে দিন সাংবাদিকদের মারধরের অভিযোগে যে পাঁচ জনের নাম পুলিশকে জানানো হয়েছিল, তাঁরা এ দিন আলিপুর আদালতে আত্মসমর্পন করেন। প্রত্যেককেই জামিন দেন বিচারক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy