গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
বিধায়ক হয়েছেন ২০১১ সালে। রাজনীতিতে একেবারে আনকোরা হয়েও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ‘জায়ান্ট কিলার’ হিসেবে। কিন্তু গত দু’তিনটে সপ্তাহে যে পরিমাণ রাজনৈতিক তৎপরতা দেখিয়েছেন তিনি, রায়দিঘির ‘মুকুটহীন রাজা’কে হারানোর সময়েও ততটা দেখাতে হয়নি। রাজনীতির মাঠে তাঁর ব্যক্তিগত সক্রিয়তা দেখা গেল এই প্রথম বার। আর তৎক্ষণাৎই সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।
দেবশ্রী রায় এখন ঘরেরও নন, পরেরও নন। সেই দশা কাটাতে মরিয়া হয়ে নিজের নাগালে থাকা সব দরজায় কড়া নাড়ছেন রায়দিঘির বিধায়ক। পরিস্থিতি এমনই যে, তাঁর হয়ে বিজেপি নেতৃত্বের কাছে দরবার করতে হয়েছে এক তৃণমূল সাংসদকেও। তবু ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত।
আট বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য দেবশ্রী রায়। গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন যিনি, সেই কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে ২০১১ সালে হারিয়ে দিয়েছিলেন দেবশ্রী রায়। কস্মিন কালেও রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ না থাকা এক অভিনেত্রী হারিয়ে দেবেন তদানীন্তন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রীকে, ভাবতে পারেননি সে বার অনেকেই।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। ২০১১ সালে ভোটে জেতার পর থেকে আর কখনও কোনও ইতিবাচক কারণে চর্চায় উঠে আসেনি তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়ের নাম। কান্তিকে হারিয়ে সেই যে কলকাতা ফিরলেন, আর রায়দিঘিমুখো হলেন না— এমন কথাই বরং শোনা যেতে শুরু করেছিল কয়েক বছর পর থেকে। ‘নিখোঁজ’ পোস্টারও পড়েছিল তাঁর নামে।
তাতে অবশ্য দেবশ্রী রায়ের কোনও সমস্যা হয়নি। ২০১৬ সালে ফের টিকিট পান। ‘হারবেন-হারবেন’ রবটা আবার ওঠে। কিন্তু আবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি জেতেন।
রাজনীতির ময়দান না চেনা, নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন রাখা, বিধানসভায় প্রায় কোনও আলোচনায় অংশ না নেওয়া দেবশ্রী রায়ের এই সাফল্য তা হলে কোন পথে? তৃণমূলের অনেকেই এখনও স্বীকার করেন যে, দেবশ্রীর সাফল্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের তদানীন্তন সভাপতি তথা অধুনা বিজেপি নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কল্যাণে। শোভনের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল অভিনেত্রীর। তাই তাঁকে টিকিট পাইয়ে দেওয়া থেকে জিতিয়ে আনা, সবই সামলে নিয়েছিলেন শোভন। সেই শোভনের পথেই এখন সবচেয়ে বড় কাঁটা হয়ে উঠেছেন দেবশ্রী। তবে ঘটনাপ্রবাহ এমন বাঁকে হাজির হয়েছে যে, রায়দিঘির বিধায়কের দুই কূলই এখন অনিশ্চিত।
আরও পড়ুন: সারদার থেকে নেওয়া ৩১ লক্ষ টাকা ফেরত দিলেন শতাব্দী রায়
১৪ অগস্ট থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে খুব চর্চিত নাম হয়ে উঠেছেন দেবশ্রী রায়। বিজেপিতে শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক যোগদানের সামান্য আগেই নয়াদিল্লিতে বিজেপি সদর দফতরে সে দিন পৌঁছেছিলেন দেবশ্রী। তা নিয়ে ঝড় উঠে গিয়েছিল বিজেপি দফতরে। শোভনের সঙ্গে দেবশ্রীর সম্পর্ক এখন মোটেই ভাল নয়। তাই শোভনরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, দেবশ্রীকে বিজেপিতে নেওয়া হলে তাঁরা যোগদান করবেন না। ফলে রায়দিঘির বিধায়ককে বিজেপিতে স্বাগত জানানোর প্রক্রিয়া আটকে যায়। শোভনদের যোগদান সম্পন্ন হয়। তার পরে বিজেপির কার্যকরী সভাপতি জে পি নাড্ডার সঙ্গে দেখা করেও দেবশ্রী রায়ের বিষয়ে নিজেদের আপত্তির কথা শোভনরা জানিয়ে দেন।
সেই থেকেই ঝুলে রয়েছেন দেবশ্রী রায়। তৃণমূল বিধায়ক হাজির হয়ে গিয়েছেন বিজেপি সদর দফতরে, দলবদল করতে চাইছেন, তার পরে বাধা পেয়ে ফিরে আসছেন— এই দৃশ্য সর্বসমক্ষে এসে যাওয়ার পরে সেই বিধায়কের অবস্থা তৃণমূলের অন্দরে কেমন হতে পারে, তা আঁচ করা শক্ত নয়। দেবশ্রীর এই কাণ্ড নিয়ে তৃণমূল খুব কঠোর কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ঠিকই। কিন্তু দলের সঙ্গে রায়দিঘির বিধায়কের সম্পর্কের মাঝে যে বিস্তর অস্বস্তির পাঁচিল উঠে যাওয়াই স্বাভাবিক, তা নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়।
আরও পড়ুন: পঞ্জাবের গুরদাসপুরে বাজি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ, অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু
দেবশ্রী রায় অতএব মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন বিজেপিতে যোগদান করার। পূর্বপরিচিতির সূত্র ধরে বিজেপির এক মহিলা সাংসদকে দেবশ্রী প্রথমে অনুরোধ করেছিলেন, দলের দরজা তাঁর জন্য খোলার ব্যবস্থা করতে। ওই বিজেপি সাংসদ দেবশ্রীকে আশ্বস্ত করেন এবং এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে অনুরোধ করেন দেবশ্রীর বিষয়টি দেখার জন্য।
এতেই থামেননি দেবশ্রী রায়। ভক্তিগীতির জন্য বিখ্যাত এক গায়িকার দ্বারস্থ হন তিনি। ওই অবাঙালি গায়িকার সঙ্গে সঙ্ঘের শীর্ষ নেতৃত্বের সম্পর্ক ভাল। তাঁকে ধরে সঙ্ঘের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন তৃণমূল বিধায়ক। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি বলেই খবর।
অবশেষে সরাসরি তিনি হাজির হয়ে যান রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের দরবারে। প্রথম দিন দিলীপের বাড়ি গিয়েও দেবশ্রী তাঁর দেখা পাননি। পরের দিন অবশ্য দেখা হয়। দলে জায়গা দেওয়ার বিষয়ে দেবশ্রীকে দিলীপ আশ্বস্ত করেন বলেও খবর।
তবে রাজনৈতিক শিবির চমকে গিয়েছে এই প্রক্রিয়ায় এক তৃণমূল সাংসদের ভূমিকার কথা শুনে। দেবশ্রী রায়কে দলে নেওয়ার বিষয়ে রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষনেতাকে অনুরোধ করেছেন তৃণমূলেরই এক মহিলা সাংসদ। জানা গিয়েছে এমনও। এ বারই প্রথম সাংসদ হয়েছে তিনি। দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও অত্যন্ত ভাল। তৃণমূলে দেবশ্রীর আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই এবং এখন বিজেপি তাঁকে না নিলে দেবশ্রী অথৈ জলে পড়বেন— এ ভাবেই ওই মহিলা তৃণমূল সাংসদ রাজ্য বিজেপির ওই শীর্ষনেতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বলে খবর।
তৃণমূল সাংসদের কাছ থেকে এই অনুরোধ যে এসেছে, তা বিজেপি সূত্রেও কিন্তু অস্বীকার করা হয়নি। তবে যাঁর দরবারে অনুরোধ জানানো হয়েছে, সেই বিজেপি নেতা ওই তৃণমূল সাংসদকে কী আশ্বাস দিয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়।
তৃণমূলের এক সাংসদই দলের এক বিধায়ককে বিজেপিতে ভিড়িয়ে দিতে চাইছেন! এই খবরে রাজনৈতিক শিবিরে গুঞ্জন তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। শুধুমাত্র বন্ধুত্বের খাতিরেই কি দেবশ্রীর হয়ে এই দরবার করেছেন ওই তৃণমূল সাংসদ? নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনও রাজনৈতিক নকশা রয়েছে? দেবশ্রীকে বিজেপিতে নেওয়া হলেই তিনি দল ছেড়ে দেবেন— আগেই বলেছিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র। তৃণমূল কি এখন সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে? দেবশ্রীকে বিজেপিতে ঢুকিয়ে কি গেরুয়া শিবির থেকে শোভনের প্রস্থান নিশ্চিত করতে চাইছে রাজ্যের শাসক দল? এই রকম বেশ কিছু প্রশ্ন ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে।
দেবশ্রী রায়কে বিজেপিতে নেওয়া হবে না— এ রকম কথা এক বারও বলেননি রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি বার বারই বলেছেন, দলের দরজা সবার জন্য খোলা। কখনও কখনও তার সঙ্গে জানিয়েছেন যে, দেবশ্রী রায়ের বিষয়ে এখনও কিছু আলাপ-আলোচনা দরকার। তবে কাকে নেওয়া হবে বা নেওয়া হবে না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন— এমন মন্তব্যও মঙ্গলবারই দিলীপ করেছেন।
টানাপড়েন যে একটা রয়েছে, তা বোঝা শক্ত নয়। দেবশ্রী রায়কে স্বাগত জানাতে দিলীপ ঘোষের কোনও আপত্তি নেই, এ কথা স্পষ্ট। কিন্তু সদ্য দলে আসা শোভনের যে আপত্তি রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট। বিজেপিতে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় দিলীপের যে প্রভাব, শোভন তার ধারেকাছেও নেই আপাতত। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেবশ্রীর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিজেপি নিতে পারেনি এখনও। এর থেকেই স্পষ্ট যে, রায়দিঘির তৃণমূল বিধায়ককে স্বাগত জানানোর প্রশ্নে বিজেপির মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এখনও যথেষ্টই রয়েছে।
এ বিষয়ে দেবশ্রী রায়ের কোনও প্রতিক্রিয়া কিন্তু এখনও মেলেনি। ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ১৪ অগস্টের পর থেকেই অধরা তিনি।
ত্রিশঙ্কু দশায় ঝুলে গিয়েছেন দেবশ্রী রায়। অদ্ভুত বৈপরীত্য তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথ ঘিরে। রাজনৈতিক ভাবে যখন তৎপর ছিলেন না একেবারেই, তখন পর পর সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু তৎপর যখন হলেন, তখন পথ হারানোর দশা। কড়া নাড়ছেন একের পর এক দরজায়। কিন্তু রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy